নিজস্ব প্রতিবেদক

১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০১:২৯

দিনভর যা ঘটলো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে

প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলনে নামে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা। রোববার আন্দোলনের চতুর্থ দিনে এসে যা সহিংস রুপ নেয়।

উপচার্যকে ধাওয়া ও অবরুদ্ধ, আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের হামলার পর পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। যার জেরে রাতে জরুরী সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেন উপচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। একইসঙ্গে সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থ দের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন তিনি।

যার পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে সিরাজুন্নেসা হলের সেই প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা পত্যাগ করেছেন বলেও জানান উপাচার্য। তার স্থলে বিশ্ববদ্যিালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরীকে নতুন প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ
শাবি ছাত্রীদের আন্দোলনের তৃতীয় দিনে শনিবার সন্ধ্যায় হামলার অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনকারী ছাত্রীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচীতে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ। যদিও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

এই হামলার প্রতিবাদ ও তিনদফা দাবি আদায়ে রোববার সকাল থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে বিশ^বদ্যিালয়ের গোল চত্বর ও প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী ছাত্রীরা। কিছু ছাত্রও তাদের সাথে যোগ দেয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর যান চলাচল বন্ধ করে দেন তারা।

দুপুরের দিকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে নিজ কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। বৈঠক  থেকে বেরিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম, প্রক্টর আলমগীর কবীরসহ কয়েকজন শিক্ষক আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করতে আসেন। তারা জানান, উপাচার্য তাদের সব দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন। তবে এজন এক সপ্তাহের সময় চেয়েছেন তিনি।

তবে ছাত্রীরা এমন আশ্বাস না মেনে শ্লোগান শুরু করে। একটু পরই ক্যাম্পাসে মিছির বের করে তারা।

অবরুদ্ধ উপাচার্য
ছাত্রীরা যখন মিছির করছিলেন তখন বাসভবনে যাওয়ার জন্য নিজ কার্যালয় থেকে বের হন উপাচার্য। উপাচার্য বের হয়ে যাচ্ছেন এমন খবর আন্দোলনকারীদের কাছে পৌছার পর তারা উপাচার্যের দিকে ছুটে যান। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শ্লোগানও দিতে থাকেন। এসময় উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আরো কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা উপাচার্যকে ঘিরে ধরে ড. ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনের ভেতরে নিয়ে যান।

শিক্ষকদের অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা উপাচার্যকে ধাওয়া করে। এসময় আইআইসিটি ভবনে আশ্রয় নেন তিনি। তবে ছাত্রীদের দাবি, ধাওয়া নয় বরং উপাচার্যের সাথে আলোচনা করতে এসেছিলেন তারা। কিন্তু উপাচার্য তাদের কথা না শুনে দৌড়ে আইআইসিটি ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন।

উপাচার্য আইআইসিটি ভবনের ভেতরে প্রবেশের পর ওই ভবনের ফটকের সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টার দিকে তারা ভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপাচার্য। শিক্ষার্থীরা ওই ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নিজেদের দাবির পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে।

আন্দোলনস্থলে পুলিশের অবস্থান, উত্তেজনা
বিকেল ৪টার দিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনস্থলে এসে পৌছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে দুই শতাধিক পুলিশসদস্য আইআইসিটি ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে মূর্হূমূহ ম্লোগান দিতে থাকে।

হামলা এড়াতে এসময় আন্দোলনকারীরা হাতে ফুল নিয়ে পুলিশকে স্বাগত জানায়। তবে দীর্ঘক্ষণ পুলিশ নীরব অবস্থানেই ছিলো। এ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম, প্রক্টর আলমগীর কবীরসহ জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা আন্দোলনকারীদের আলোচনা করেন। তারা আন্দোলনকারীদের সব দাবি মানার আশ্বাস দিয়ে উপাচার্যকে মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি লিখিত আকারে জানাতে বলে। লিখিত না দিলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় তারা। এনিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা ও বাকবিতন্ডা চলে।

পুলিশের হামলা-সংঘর্ষ
শিক্ষকরা আলোচনার মাধ্যমে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উপাচার্যকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হলে একশনে নামে পুলিশ। সন্ধ্যার ঠিক আগ মূহূর্তে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে অবরুদ্ধ উপাচার্যকে মুক্ত করতে এগিয়ে যায় পুলিশ। এসময় দুইপক্ষে ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়। পরে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্য করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

পুলিশের লাঠিচার্যে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক পিছু হটলেও পরে পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে তারা। এ পর্যায়ে পিছু হটে পুলিশ। পরে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুঁড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। এসময় ক্যাম্পাসজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দেয়। এসময় গুলির ঘটনাও ঘটে। গুলিতে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার আজবাহর আলী শেখ সহ ১০ পুলিশ সদস্যও আহত হন। আহত হন শিক্ষার্থী, বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত ৫০ জন। শিক্ষার্থীদের কয়েকজন রাবার বুলেটেও আহত হন। এই সংঘর্ষকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবষÍান নিয়েছিলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরও লাঠিপেটা করে পুলিশ। তাদেরও কয়েকজন আহত হন।

আহতদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার পর উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিজ বাসভবনে নিয়ে যান পুলিশ ও শিক্ষকরা।

শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার আজবাহর আলী শেখ বলেন, আমরা হামলা করিনি। আমরা উপাচার্যকে মুক্ত করে আনতে গিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীরাই আমাদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তিনি বলেন সংঘািত থামতে পুলিশ ২১ টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ৩০ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে।

তবে এই অবস্থার জন্য শিক্ষার্থীদেরই দায়ী করেছেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাকে ধাওয়া করে অবরুদ্ধ করার মাধ্যমে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তারা শান্তিপূর্ণ আলোচনার সব প্রস্তাব নাকচ করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
সংঘর্ষের পর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নিজ বাসভভনে জরুরী সিন্ডিকেট সভা ডাকেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ। সিন্ডিকেট বৈঠক শেষে রাত ৮টার দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন উপাচার্য।

উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন,  যার পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিলেন সেই প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করেছেন। তার পরিবর্তে বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা হলেও প্রশাসনিক সব কার্যক্রম চলবে বলে জানান উপাচার্য।

এখন্ও বিক্ষোভ
পুলিশের সাথে সংঘর্ষের পরই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিশ্বববিদালয়ের মূল ফটকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু কর। ফটক বন্ধ করে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ছাড়ার ঘোষণার পর বিভিন্ন ছাত্র হলেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে জড়ো হয়ে এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করে। হল ছাড়বে না বলেও ঘোষণা দেয় বঙ্গবন্ধু, শাহপরান ও সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ছাত্ররা।

সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান খান বলেন, ‘অনির্দিষ্টকালের বন্ধের কারণে আমরা বিপাকে পড়েছি। হুট করে ১২টার মধ্যে কোথায় যাব? করোনার কারণে এমনিতেই আমাদের শিক্ষাজীবন সংকটে। এখন হল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কারণে আরও সমস্যায় পড়ব।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ সামিউল ইসলাম জানান, এটা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত; তাদের কিছু করার নেই।

সিদ্ধান্ত না মেনে কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, প্রাধ্যক্ষ জাফরিনের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তারা সরে যান। দাবি পূরণ না হওয়ায় শনিবার সন্ধ্যায় ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক আটকে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন।

মধ্যরাতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে গেলেও রোববার সকাল থেকে ফের শুরু হয় তাদের বিক্ষোভ। তাতে যোগ দেন সহপাঠীরাও।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত