রাবি প্রতিনিধি

১৩ জুলাই, ২০১৭ ২২:৫০

‘সাংবাদিকের উপর হামলাকারীদের বিষয়ে প্রশাসনের উদাসীনতা আশ্চর্যজনক’

‘আপনারা প্রক্টরিয়াল বডির এতো বিধি-নিষেধ, পরিচয়পত্র দেখাতে হবে, সন্ধ্যায় এটা করা যাবে না, ওটা করতে বাধা। প্রক্টরিয়াল বডি মিলে ক্যাম্পাসটাকে পুলিশ ক্যাম্পে পরিণত করতে পারেন অথচ আপনার ছেলেদের ওপর দৈহিক হামলা হবে তার তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন না? এমন প্রক্টরিয়াল বডি আমরা চাই না। আর এখন অবধি কেনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো না তা খুবই আশ্চর্যজনক।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রতিনিধি আরাফাত রহমানকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্তদের  দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দাবিতে বিভাগকর্তৃক আয়োজিত মানববন্ধনে এসব কথা বলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) বেলা ১২টায় ওই বিভাগের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

সেলিম রেজা নিউটন আরো বলেন, ‘আমরা ছাত্রলীগকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, একটা সময় ছিল যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রলীগ নেতাও ছিল না। আমাদের শিক্ষকদের পিছনে সাধারণ শিক্ষার্থীর পরিচয়ে সেদিন আপনাদের মিছিল করতে হয়েছিল।

যারা মনে করেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবিরকে তাড়িয়েছেন একটা নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠন। আমি পরিস্কার করে বলতে চাই, তাদের বয়সের চেয়ে আমার বয়স অনেক বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ২৪ বছর ধরে দেখছি। এখানে শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, নিগৃহীত হয়েছে, হাতুড়ি পেটা হয়েছে, ড্রিল দিয়ে ছিদ্র করা হয়েছে, হল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

একটা অদ্ভুত বিষয়, ছাত্রলীগ নিয়ে নাকি সমালোচনা করা যাবে না। আমরা মনে করি ছাত্রলীগ কেন, বাংলাদেশে প্রত্যেকটি বিষয়ে সমালোচনা করা যাবে। সেটা যে কেউ হোক। এত পাতলা চামড়া হলে রাজনীতি করা যাবে না। এত স্বেচ্ছাচারী হুকুম জারি করা যাবে না। আমরা কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবি না। আমরা এখানে জ্ঞান চর্চা করার জন্য এসেছি।

এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে সমস্যাটা শুধু ছাত্রলীগের নয়। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, সবসময়ই বড় বড় রাজনৈতিক দল, যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে দখল করতে চান, তারাই তাদের ছাত্রশাখাকে ব্যবহার করেন। তারা অল্প বয়সী ছেলেদের ব্যবহার করেন কারণ তারা ক্যাম্পাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। এটা প্রত্যেকটা দলই করেছে।

যারা এটা করছেন তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি করছেন। এই রকম ক্ষতিকর কাজ করার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের উপকার হবে না। আওয়ামী লীগের যে ইতিহাস আছে তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেগে ওঠার ইতিহাস, সাংবাদিকদের উপযুক্ত কর্তব্য পালনের ইতিহাস।

আজ আমরা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাস বাদ দিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছি। দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমরা বিপদে পড়েছি। এই বিপদ ব্যক্তিগত নয়। এই বিপদ শুধু আমাদের বিভাগের নয়, এই বিপদ সাংবাদিকতা পেশার। এই বিপদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা গোটা বাংলাদেশের। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতেই হবে।

আরাফাত রহমান সেদিন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিল। তার ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে। আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের দণ্ডবিধির কাছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং যে ছাত্র সংগঠনের নাম ব্যবহার করলে তাদের কর্মীদের মনে এত বড় ক্ষমতা জাগ্রত হয়, যা কিছু তাই করার কথা ভাবতে পারেন; সেই সংগঠনের কাছে হামলাকারীদের শাস্তি চাই।

ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তারা বলেছেন একটা বিচার করা হয়েছে, দুজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আরাফাত নিজে তার ওপরে যারা হামলা করেছে বলে সুনির্দিষ্ট করে নাম উল্লেখ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যা করেছে তা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা বলেছেন, না আমাদের ছেলেরা এসব করেনি। এটা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ নেতাদের প্রশ্রয়, উসকানি কোনো না কোনো ভাবে এতে আছে।

আমাদের ছেলেদের ওপরে দৈহিকভাবে হামলা আসলে আমাদেরকে আমাদের আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য, আমরা সম্ভাব্য যা করতে পারি তা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যদি আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে না পারি তবে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রেখে কী লাভ। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমস্যা মনে করেন তারা পরিষ্কার করে দাবি তুলেন না কেন, বাংলাদেশকে থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উঠে যাক। বাংলাদেশে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর থাক।’

প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলা এ মানববন্ধনে আরাফাতের ওপর হামলার বিচার দাবি করে বিভাগের সভাপতি ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে বলেন, আমরা বারবার এভাবে রাস্তায় দাঁড়াতে চাই না। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আরাফাত যেভাবে নৃশংস হামলার শিকার হয়েছে, তার বিচার চাই।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ-আল মামুন, সহকারী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ, মাহাবুবুর রহমান, মামুন আব্দুল কাইয়ুম।

বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদ রিন্টুর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরো বক্তব্য দেন বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহীল বাকী, শিক্ষার্থী আহমেদ সজীব, শিহাবুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাঈদ, রাব্বিউল ইসলাম, শিমুল হোসেন প্রমুখ। মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, রাবি রিপোটার্স ইউনিটি, রাবি প্রেসক্লাব ও ঝিনাইদহ জেলা সমিতি।

উল্লেখ্য, সোমবার (১০ জুলাই) বাস ভাঙচুরের ছবি তোলায় সাংবাদিক আরাফাত রহমানকে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এ ঘটনায় আরাফাত রহমান বাদী হয়ে মতিহার থানার রাবি ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কানন, আইন বিষয়ক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বিজয়, সহ-সভাপতি আহমেদ সজীব, সাংগঠনিক সম্পাদক আবিদ আহসান লাবন ও অজ্ঞাতনামা ৮-১০ জনকে আসামি করে দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৩ ও ৩২৫ ধারায় মামলা দায়ের করেন।

অন্যদিকে দেশ ট্রাভেলসের ওই বাস ভাঙচুরের ঘটনায় বাসের সুপারভাইজার মানিক হোসেনও বাদী হয়ে ওই চার নেতার বিরুদ্ধে নগরীর মতিহার থানায় মামলা দায়ের করেন। তবে হামলার চার দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত