মিহিরকান্তি চৌধুরী

২৬ মে, ২০২০ ২০:৫৮

স্মরণ: সুরাইয়া রাজা চৌধুরী

প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলার সাবেক পরিচালিকা, বিশিষ্ট সমাজসেবী, সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনের একনিষ্ঠ কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজন ও উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভাবনার এক মূর্ত প্রতীক মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী গতকাল (২৫ মে ২০২০) রাত আট ঘটিকার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আজ সকালে এই দুঃসংবাদ শুনে মনে হলো একই সাথে দুটা ঝড় বয়ে গেল, একটা বাইরে আর একটা মনের ভিতরে। সুরাইয়া আপা সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর সাথে আমার ও আমাদের পরিবারের বহুমাত্রিক যোগাযোগ। তাঁর সাথে, তাঁর স্বামী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরীর সাথে, তাঁর পরিবারের কাছে আমার ও আমাদের ঋণও বহুমাত্রিক। এ ঋণ এক জীবনে তো শোধ হবার নয়ই, বহু জীবনেও নয়।

সুরাইয়া আপার বাবার বাড়ি ছিল আসামের করিমগঞ্জ এলাকার আলীনগরে। সেখান থেকে দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে তাঁরা আমাদের গ্রাম শ্রীধরপুরে (বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর বা লাতু এলাকা) বসতি স্থাপন করেন। শ্রীধরপুর আসার পর আমাদের পরিবারের সাথে, আমার বাবা প্রয়াত নিবারণচন্দ্র চৌধুরীর সাথে তাঁদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যদিও যাঁদের সাথে তাঁরা বিনিময় করেছেন তাঁদের সাথে আমাদের পরিবারের জায়গাজমি সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা ছিল, নিত্যদিনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না যদিও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

সুরাইয়া আপার বড় ভাই বদরুল ইসলাম চৌধুরী এলাকায় হেলাল মিয়া ও জজ সাহেব উভয় নামে পরিচিত ছিলেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। ছিলেন মুন্সেফ থেকে শুরু করে জেলা জজ। পরে বিচারপতিও হয়েছিলেন। সুনাম ছিল প্রচুর। আমার বাবাকে কাকার মর্যাদা দিতেন, সম্মান করতেন। সুরাইয়া আপার মতো আমরাও তাঁকে ‘বড় ভাই’ সম্বোধন করতাম, সম্মান করতাম, পায়ে ধরে সালাম করতাম। বড় বোন হিসেবে সুরাইয়া আপা ও আমাদের ভাইবোনদের ‘দুলাভাই’ সম্বোধিত অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবকেও গুরুজনের মর্যাদায় পায়ে ধরে সালাম করতাম।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৪ সালে আমাদের পরিবার সিলেট আসে। সুরাইয়া আপার সাথে দেখা করি। জানতে পারি তাঁদের কুমারপাড়ার বাসার কম্পাউন্ডেই ভাড়া দেওয়ার উপযুক্ত একটি বাসা খালি। আমরা সেখানে চলে আসি। বাসার সাথে সাথে সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের অভিভাবকত্বেও চলে আসি আমরা। কিছুদিন পর কম্পাউন্ডেই আরেকটি বাসায় চলে আসেন আমাদের এলাকার ভুগা গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কুতুব মিয়া নামে পরিচিত আব্দুস সহীদ চৌধুরী। কুতুব মিয়া সুরাইয়া আপার কাজিন ছাড়াও আমাদের এলাকার সম্পর্কে ভাই সম্পর্কিত হওয়ায় আমরা ভাই মানতাম, দাদা ডাকতাম। উভয় পরিবারের সাথে অসাধারণ মানদণ্ডে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রার এক নবায়ন। তিন পরিবার মিলে শাহবাজপুরের এক পরিবেশ ছিল।

অতি আপনজনের চেয়েও আপন হয়ে যান তাঁরা। সিলেট আসার কিছুদিন পরেই আমাদের মা লিভারের রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন রোগভোগের পর মারা যান। আমার মা-কেও তাঁরা সম্মান করেছেন, নিত্য খোঁজখবর নিয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধকার্য থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সকল ক্রিয়াতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের বাসার আঙিনা ব্যবহার করতে দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে আমার ছোট বোন মুক্তার বিয়েতেও সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের অভিভাবকত্ব ও সহযোগিতা কোনদিনই ভুলবার নয়। তিন ধাপে তাঁদের বাসার কম্পাউন্ড ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের চেম্বারের আসবাবপত্র সরিয়ে বরের বসার স্থান করে দিয়েছেন। তাঁদের পরিবারের কর্মসহযোগী কালাই মিয়া (আমাদের শ্রীধরপুরের), উসমান মিয়া ও তাহের মিয়াসহ অন্যদের আমাদের প্রয়োজনীয় সকল সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। আমার ভাইবোনের বিয়ে, মেয়ের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে সপরিবার উপস্থিত থেকে সোনার সামগ্রী উপহারসহ আশীর্বাদ করেছিলেন। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সমাজে খুব ঘনিষ্ঠ ছাড়া স্বর্ণবিশেষ উপহারের রেওয়াজ নেই । তাই অনুমেয় তাঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ক। কয়েক বছর আগে আমার ভগ্নিপতির অকাল মৃত্যুর পর সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেব তাদের মেজরটিলার বাসাতে গিয়ে সশরীরে শোক ও সান্ত্বনা জানিয়েছিলেন। সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবসহ তাঁদের পরিবারের সকলেই অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভাবনার অধিকারী ছিলেন।

সুরাইয়া আপার অনেক আত্মীয়স্বজন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পুলিশের আইজি, সচিব, জজ, বিচারপতি থেকে শুরু করে ফরেন সার্ভিস কত কিছু। উনারা যখন আসতেন, তাঁদের অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন, “মিহির, শ্রীধরপুরের কাকাবাবুর ছেলে।” অনেক সময় এমনও হয়েছে, তাহের মিয়াকে পাঠিয়ে খবর দিয়ে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই শ্রীধরপুর বলতে আমার বাবাকে চিনতেন। আত্মীয় হিসেবে সুরাইয়া আপার শ্রীধরপুরের বাড়িতে তাঁদের যাতায়াত ছিল, তাঁদের অনেকের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির যোগাযোগও ছিল।

সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের ভাবমূর্তি ছিল অসাধারণ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। শ্রদ্ধাবোধ থেকে সবাই সমীহ করত। তাঁদের প্রযত্নে থাকার দরুন অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমাদের সাথে লাগাবাজা করেনি। প্রতিপক্ষ মেধাবী ছিল। বুঝত, হিসেবে নিত তারা লাগবে যার সাথে সে কার ভাই, কার আত্মীয়, কার স্নেহভাজন ।

সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের ছোট ছেলে সাকিব আহমেদ চৌধুরী ও ছোট মেয়ে তহুরা সুলেমান তান্নি আমার ছাত্র। সাকিবের স্ত্রীও ছাত্রী ছিলেন। বড় ছেলে সয়েফ আহমেদ চৌধুরী ও বড় মেয়ে হেলী চৌধুরীর সাথে আমার ও আমাদের পরিবারের সকলের সুসম্পর্ক ছিল। সুসম্পর্ক ছিল বিচারপতি বদরুল ইসলাম চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলে সামি চৌধুরীর সাথে। সবারই চলাফেরা, কথাবার্তা সবকিছুতেই রুচির পরিচয় ছিল। রুচি পানির মতো, উপর থেকে নিচে নামে। ছোট মেয়ে তহুরা সুলেমান তান্নি একজন ভালো রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও নৃত্যশিল্পী ছিল। পরবর্তী সময়ে এই দুই শিল্পের চর্চা অব্যাহত রাখলে অন্য ধরণের এক পরিচিতি আসতে পারত। পরিচয় হয় সুরাইয়া আপার বড় বোনের সাথে। শহরের হাউজিং এস্টেটে তাঁর মেয়ে কবি-সাংবাদিক ও লেখিকা মিসেস সামসাদ হুসাম চৌধুরীর বাসায় থাকতেন। মিসেস সামসাদ হুসাম চৌধুরী ও জনাব হুসাম আহমেদ চৌধুরীর মেয়ে আজরা ও ছেলে নাদভী আমার ছাত্র। তাঁদের সকলের সাথেও আমার ও আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। মিসেস সামসাদ হুসাম সম্পর্ক আমার ভাগ্নি হলেও বয়সে বড় হিসেবে, সম্মানীয় হিসেবে তাঁকে খালা ডাকি। সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের বাসায় ও সামসাদ খালার বাসায় সকল আনন্দানুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ ছিল। এতোই কাছের, এতোই আপন তাঁরা সকলে। সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী তো আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেনই, মিসেস সামসাদ হুসাম চৌধুরী ও জনাব হুসাম আহমেদ চৌধুরীও ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেব তো আমাদের আপনজন ছিলেন। তাঁদের বাসাও ছিল আমাদের বাসা। কত ভালো ভালো খাবার খেয়েছি তার শেষ নেই। তাঁদের ভিতরের ড্রয়িং রুমে বসে কত খেলা, কত অনুষ্ঠান দেখেছি তারও শেষ নেই। তাঁদের সিলেট-ক ৪৪৩০ নম্বরের টয়োটা কার কত চড়েছি তারও শেষ নেই। সুবিধা অসুবিধায় কত ধরণের কত সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তার শেষ নেই । আমাদের প্রতি তাঁদের স্নেহভালোবাসার শেষ ছিল না। এক পর্যায়ে আমরা অন্যত্র চলে আসলেও খোঁজখবর নেওয়া, যোগাযোগ অব্যাহত ছিল, অব্যাহত ছিল তাঁদের স্নেহভালোবাসা, অব্যাহত ছিল আমাদের শ্রদ্ধাবোধ।

আমার ও আমাদের সিলেটে আসা, এখানকার সমাজের সাথে যুক্ত হওয়া, আমার শিক্ষকতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া, স্বীকৃতি পাওয়া ইত্যাদির পেছনে প্রথম পর্যায়ে পাঁচজন লোকের অবদান আছে। তাঁরা হলেন মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী, ব্লু বার্ড স্কুলের (পরবর্তীতে স্কুল ও কলেজ) অধ্যক্ষা মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ, মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও আমার ভাগ্নির জামাই কানুমামা বা হিমাংশু পুরকায়স্থ। তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আছি, থাকব।

১৯৮৭ সালে আমার প্রতিষ্ঠান একাডেমি অব টু আরস থেকে পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজন করি। সুরাইয়া আপা, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেব ও তাঁদের ছেলেমেয়ে সাকিব ও তান্নি অসাধারণ মানদণ্ডে সহযোগিতা করেছেন।

সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনে সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর অনেক অবদান ছিল । তিনি নিঃস্বার্থভাবে নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। তিনি সমাজসেবী হিসেবে সিলেটের অসংখ্য সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সুরাইয়া আপা ও অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন প্রতিভার সাথেও পরিচিতি হয়, হয় ঘনিষ্ঠতা। তাঁদের মধ্যে আছেন তাঁদের মেয়ে তান্নির সংগীত শিক্ষক খ্যাতিমান রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রানা সিনহা দাদা, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের ওই সময়ের জুনিয়র পরবর্তী সময়ের খ্যাতিমান আইনজীবী ই ইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন ভাই ও আরও কয়েকজন। খ্যাতিমান নৃত্যশিক্ষক আশির দশকেই অকালে প্রয়াত হন। তিনি সিলেটের এক সম্পদ ছিলেন। আশির দশকে তাঁদের বাসায় ব্যাডমিন্টন খেলার অসামান্য এক আয়োজন ও পরিবেশ ছিল। সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেব ও তাঁর ছেলেমেয়েরা, সামি চৌধুরী, রানা সিনহা দাদা ও মাঝে মধ্যে আমি। কম খেললেও নিয়মিত দর্শক ছিলাম।

সুরাইয়া আপা সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর মতো একজন বহুমাত্রিক প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে আমি, আমার ভাইবোন, স্ত্রী পুত্রকন্যা সকলেই শোকাহত। আমরা কী আঘাত পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শুধু প্রার্থনাই করতে পারব।

আপনার মৃত্যু হয়নি। শুধুই প্রস্থান করেছেন। থাকবেন আমাদের ও অগণিত সংস্কৃতিকর্মীর হৃদয়ে। নতুন ভুবনে ভালো থাকুন। সর্বশক্তিমান আপনার সেই স্থানটি নিশ্চিত করবেন নিশ্চয়ই।


মিহিরকান্তি চৌধুরী: লেখক, গবেষক, অনুবাদক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত