অনন্য আদিত্য

১৪ মে, ২০২০ ২৩:১০

চা বাগানে করোনার হানা, দায় নেবে কে?

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হন। আর সংক্রমণের ৬৪তম দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। অথচ বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সর্তকতা জারি করে ৩১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে পৃথিবীর সব মহাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে। একই দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক অনুষ্ঠানে বলেন,‘করোনাভাইরাস তেমন মারাত্মক রোগ নয়, সর্দি-জ্বরের মত। আর দেশে এটা মোটামুটি এখনও খুব বড় আকারে আসেনি।’ (১২ মার্চ আমাদের সময়)। সরকারের আরেক মন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তি স্বাস্থ্য মন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান,‘করোনাভাইরাস চলে এলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। আমরা আগে থেকেই সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে আছি।’(৩ মার্চ জনকণ্ঠ)। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যকে অসার প্রমাণ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশে বাড়তে থাকায় সরকার ২৬ মার্চ হতে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

সাধারণ ছুটির পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে সকল ধরণের গণপরিবহণ, কলকারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফার্মেসি ও নিত্যপণ্যের দোকান বাদে সকল মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। জনসমাগম এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সকলকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সময়ও বন্ধ করা হয়নি দেশের ১৬৭টি চা-বাগান। যারা কারণে দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার চা ও রাবার শ্রমিক করোনা ঝুঁকির মধ্যেও কাজ করতে বাধ্য হন। এমনকি সরকারি নির্দেশনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চা-বোর্ডের অধীনস্থ নিউ সমনবাগ, পাথারিয়া, বিটিআরআই ও দেওরাছড়া চা-বাগানেই মানা হয়নি। ক্ষুব্ধ চা-শ্রমিকরা চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের কাছ থেকে কোন নির্দেশনা ও পরামর্শ না পেয়ে স্ব-উদ্যোগে বাগানের ম্যানেজারদের নিকট ছুটি দাবি করেন। ছুটি প্রদানে ম্যানেজার অপারগতা প্রকাশ করলে ২৭ মার্চ থেকে সিলেট বিভাগের অন্তত ৬০টি চা-বাগানের শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগেই কাজ বন্ধ করে ছুটি কাটাতে থাকেন। শ্রমিকরা যখন স্ব-উদ্যোগেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন তখন মালিকদের পক্ষের চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা গাঁ বাঁচাতে বাংলাদেশিয় চা-সংসদ(মালিক সমিতি)-এর নিকট একটি চিঠি পাঠিয়ে দায় সেরেছেন।

ঠিক সেই সময়ে ৩১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা প্রশাসকদের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন,‘এতো দিন চা-বাগান চালু ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত তুলে শ্রমিকরা কাজে যেতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। সিলেটের উৎপাদনমুখী শিল্প হিসেবে এটা চালু রাখা প্রয়োজন। যেহেতু তারা দূরত্ব বজায় রেখে চা পাতা সংগ্রহ করেন, তাই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। শুধু চা পাতা জড়ো করার সময় শ্রমিকরা দূরত্ব বজায় মেনে চললে তারা নিরাপদ থাকতে পারেন।’ এব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘চা-শ্রমিকরা পাতা সংগ্রহের সময় বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। ....এবং যেহেতু তারা প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকেন, তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ফলে চা-বাগানের কার্যক্রম চলমান থাকতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর মালিকদের আর পায় কে! মালিকরা কঠোর হয়ে জানিয়ে দিলেন যারা কাজ করবে না তাদের মজুরি দেওয়া হবে না। অসহায় শ্রমিকরা আবারও দেখলো এসপি, ডিসি, মন্ত্রী-এমপি, প্রধানমন্ত্রী কেউই তাদের পক্ষে নেই। শুধু তাই নয় তাদের চাঁদায় যাদের বিত্ত-বৈভব, বাড়ি-গাড়ি সেই চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও এই দুঃসময়ে চা-শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়ালেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে দৈনিক ১০২ টাকা মজুরিতেই দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটানোই যেখানে দায় হয়ে পড়ে সেখানে মজুরি না পেলে তো আরও দুঃসহ অবস্থায় পড়তে হবে। উল্লেখ করা দরকার দুই বছর অন্তর মজুরি নির্ধারণের কথা থাকলে চা-শ্রমিকদের ১০২ টাকা মজুরির মেয়াদ ২০১৮ সালে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি, ইউনিয়নের নেতারাও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের চাইতে মালিকের দয়াদাক্ষিণ্যে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।

শ্রমিকদের এই চরম দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়েই মালিকরা চা-শ্রমিকদের জীবন নিয়ে এমন হুমকি দিতে পারলেন! জীবনকে তুচ্ছ করে জীবিকা রক্ষায় তাই বাধ্য হয়ে ১ এপ্রিল থেকে চা-শ্রমিকরা দল বেঁধে কাজ যোগ দিলেন। কাজে যোগদান করেই রেহাই মেলেনি চা-শ্রমিকদের, কাজ বন্ধ রাখার কারণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করিয়ে মালিকপক্ষ তার উসুল তুলেছেন। অথচ একই সময়ে প্রতিবেশী ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চা-বাগানসমূহে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তারপরের ঘটনা ২৫ এপ্রিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চন্ডিছড়া চা-বাগান হতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম চরম দুঃসংবাদ আসলো।
সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চন্ডিছড়া চা-বাগানের পাঁচ বছরের এক শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। চুনারুঘাট উপজেলার ইউএনও ঐদিনই চন্ডিছড়া চা-বাগানের ১২টি বাড়ি লকডাউন করেন। এরপর ২৭ এপ্রিল কমলগঞ্জ উপজেলার সুনছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা চৈতু কর্মকার নামে একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুর ৫ দিন পর পরীক্ষার ফলাফলে জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। চৈতু কর্মকার চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীর প্রতিবেশী। নিজ প্রতিবেশীর মৃত্যুর পর রামভজন কৈরী চা-শ্রমিকদের ছুটির প্রেক্ষিতে কার্যকর কোন ভূমিকা নেননি। চা-বাগান বন্ধ না হওয়ায় সাধারণ শ্রমিকরা ইউনিয়নের নেতাদের দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ,‘ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন মালিকপক্ষের সাথে আঁতাত করে দাবি-দাওয়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে ছলচাতুরী করছে।’ (১৫ এপ্রিল, দৈনিক দেশরূপান্তর)।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৩ মে পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেট বিভাগে মৃত্যু সংখ্যা ৬ জন, যার মধ্যে চা-বাগানেরই ২ জন। এছাড়া ১৯ এপ্রিল জুড়ী উপজেলার সাগরনাল চা-বাগানে এক তরুণ এবং ৮ মে কমলগঞ্জ উপজেলার মৃর্ত্তিঙ্গা চা-বাগানের এক নারী করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। করোনা আক্রান্ত হয়েছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফুলছড়া চা-বাগানের এক তরুণী, চন্ডিছড়া চা-বাগানের মৃত্যুবরণকারী শিশুটির এক স্বজন, মাধবপুর উপজেলার সুরমা চা-বাগানের মেডিকেল অফিসারসহ কয়েকজন। বলাবাহুল্য সারাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে পরীক্ষা করতে না পারায় আক্রান্ত রোগীর চেয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা যেমন অনেক কম, তেমনি চা-বাগানে পরীক্ষার হার আরও অনেক কম।

চা-বোর্ড বাগান খোলার রাখার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করলেও অধিকাংশ বাগানে তা না মেনেই কাজ করানো হচ্ছে, এমনকি চা বোর্ড বা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এব্যাপারে কোন তদারকিও করা হচ্ছে না। বলাবাহুল্য চা ও রাবার জীবনরক্ষাকারী এমন কোন জরুরি পণ্য নয় যে এই দুর্যোগের মুহূর্তেও উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। উপরন্তু চলতি বছর দেরিতে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় চা উৎপাদনের মৌসুমও দেরিতে শুরু হয়েছে, তাই চা শ্রমিকদের ছুটি প্রদান করলে মালিকদের আর্থিক ক্ষতিও খুব বেশি হওয়ার কথা নয়।

প্রধানমন্ত্রী প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, যার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ন্যূনতম যেটুকু নানা পেশার শ্রমিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে তাতেও চা ও রাবার শ্রমিকদের ঠাঁই হয়নি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মহামারিতে দেশে সামাজিক সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) পর্যায়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন চা-শ্রমিকরা। চা-শ্রমিকদের ঝুঁকির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন,‘এখন কাউকেই ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না। চা-বাগানের শ্রমিকরা খুব গাদাগাদি অবস্থায় থাকেন। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা উপকরণের অভাবও রয়েছে। ফলে তারা ঝুঁকির মধ্যেই আছেন। এ অবস্থায় তাদের ঘরে থাকাই ভালো। বিষয়টি আমি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকেও জানিয়েছি।’ (২৭ এপ্রিল, দৈনিক ডেইলি স্টার) শ্রমিক কলোনিতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ২২২ বর্গফুটের বাসাতে গাদাগাদি করে তারা ৭/৮ জন একত্রে বসবাস করেন। যেখানে চা-শ্রমিকরা বসবাসের জন্য ন্যূনতম মাথা গোঁজার জন্য প্রাণাতিপাত করতে হয় সেখানে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনের কথা তো ভাবাই যায় না।

অনেকেই ধারণা করছেন বাংলাদেশে মে মাসে করোনা সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে। সরকার পর্যায়ক্রমে সাত দফায় আগামী ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে সাধারণ ছুটি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট বিভাগের সবকয়টি জেলাসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় চলছে লকডাউন। এরকম পরিস্থিতিতে চা-বাগানকে আনলকড করে চা-শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন প্রায় ১০ লক্ষ চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী। ইতোমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, করোনায় আক্রান্ত (শনাক্ত) হয়েছেন তার দায় নেবে কে? আর আগামীতে যে চা-বাগানে মহামারি আকারে করোনা ছড়িয়ে পড়বে না তার নিশ্চয়তাই কে দিতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদেরকে, উত্তর দিতে হবে মালিকদেরকে, সর্বোপরি উত্তর দিতে হবে রাষ্ট্রকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত