অনন্য আদিত্য

১০ অক্টোবর, ২০১৮ ২৩:৫৬

মৃত্যুঞ্জয়ী মফিজ আলী

বৃহত্তর সিলেটের প্রগতিশীল রাজনীতির সিংহপুরুষ মফিজ আলী ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য ধোপাটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সামন্ত ভূ-স্বামী পিতা আজফর আলী ও মাতা নূরজাহান বিবির বড় ছেলে মফিজ আলী জন্মেই প্রত্যক্ষ করেন ’৩০ এর দশকের মহামন্দা, যার পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন তখনও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অতি উৎপাদন সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় নিমজ্জিত হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে; আর এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বাজার ও প্রভাব বলয়ের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি ও স¤প্রসারণের প্রশ্নে পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে চলছে। এ রকম একটি বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নয়া উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনে দ্রোহী মফিজ আলীর মত নেতৃত্বের আজ খুবই প্রয়োজন।

প্রখ্যাত এই বামপন্থী নেতা ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর ভোররাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে চিকিৎসারত অবস্থায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় মাসাধিক কাল আগে ৩০ আগস্ট কুলাউড়ায় একটি কৃষক সভা শেষ করে ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলায় নিজবাড়ির সামনের মাঠ সংলগ্ন রাস্তার পাশে মফিজ আলীকে পড়ে থাকতে দেখে জনৈক পথচারী ডাকাডাকি করে লোকজন জড়ো করে তাঁকে উদ্ধার করেন। এ সময়ে পরিবার-পরিজনরা মাটিতে পড়ে থাকা মফিজ আলীর চশমা, কৃত্রিম দাঁত আশপাশ থেকে উদ্ধার করেন। এতে করে একটা সন্দেহ থাকে রাস্তার চলন্ত কোন গাড়ির পার্শ্ব ধাক্কায় তিনি ছিটকে পড়ে ছিলেন কি না? তাই অনেকের ধারণা এটা একটা দুর্ঘটনা। রাস্তা থেকে উদ্ধারের পর তিনি জ্ঞান ফিরে পান। নিজে হাঁটাচলা করেছেন, কথা বলেছেন- অথচ বলতে পারেননি কি হয়েছিল। তিনি সম্ভবত পড়ে যাওয়ার মূহুর্ত স্মরণ করতে পারেননি বা ঐ মূহুর্তটায় স্মৃতিভ্রম ঘটেছিল। তবে তাকে শমসেরনগর নেওয়া এবং সেখানে থেকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের নেওয়ার পথে চলাফেরা করেছেন এবং কথাও বলেছেন। সময় যতই গড়িয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বৃদ্ধির সাথে সাথে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরের একপাশ নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।

বিভাগীয় শহরের পাবলিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর পরই তিনি যে অচেতন হলেন বা জ্ঞান হারালেন, বাকরুদ্ধ হলেন সে অবস্থায় থেকে তাঁকে আর ফেরানো যায়নি। এজন্য তার সহযোদ্ধা নেতাকর্মী, প্রিয়জন, পরিবার-পরিজন সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও একটি নয়া-উপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের দুরবস্থা, অব্যবস্থা সর্বোপরি গতানুগতিক ও অনান্তরিক চিকিৎসায় এদেশের অন্যতম প্রবীণ বামপন্থী নেতা মফিজ আলীকে বাঁচানো যায়নি।

চিকিৎসকরা তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণ সুনির্দিষ্ট করে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেননি। তাঁর মৃত্যু কি রক্তচাপজনিত স্ট্রোকে না কি দুর্ঘটনায় তাও নির্ধারিত হয়নি। দায়িত্বরত চিকিৎসকদের অনান্তরিকতা ও অবহেলা না হলে একটা প্রবোধ হয়তো দেওয়া যেতো। তবে এটা ঠিক যে, তিনি এভাবে আকস্মিক অসুস্থ না হলে আরও বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন। তাতে উপকৃত হতো বাংলাদেশের চা শ্রমিকসহ শ্রমিক শ্রেণি তথা জনগণ এবং প্রগতিশীল আন্দোলন। জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর পর দেখতে দেখতে ১০ বছর হয়ে গেল। ১০ অক্টোবর’১৮ তাঁর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ ভারতবর্ষের পাঠশালার ছাত্রাবস্থায়ই মফিজ আলীর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার উন্মেষ ঘটে। নানা রকম ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তাঁর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয়। মুন্সীবাজারের এম,ই স্কুল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি, মৌলভীবাজারের কাশিনাথ হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণি এবং ৮ম শ্রেণি থেকে তিনি মৌলভীবাজার সরকারী হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪৯ সালে মেট্রিক পাস করেন। মেট্রিক পাস করে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এম,সি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ছাত্র রাজনীতি করার কারণে তাঁকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এ সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি মদন মোহন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪ সালে আই,এ পাস করেন। এরপর এম,সি কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হন। সেই সময় ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসাবে এম, সি কলেজের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে গোবিন্দ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে বক্তব্য রাখার কারণে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুলেমান চৌধুরী লিখিত আদেশ প্রদান করে মফিজ আলীকে এম,সি কলেজ থেকে বহিস্কার করেন। যার কারণে ডিগ্রী পরীক্ষা দিতে না পারায় বি.এ শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় তাঁর শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ছাত্র জীবনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং সিলেট জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

মুসলিম লীগ সরকারের অপ্রতিহত দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলে ১৯৫৩ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার কমলগঞ্জ থানায় সর্বপ্রথম বিরোধী দল হিসাবে মফিজ আলীর উদ্যোগে আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠিত হয়। যখন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করতে সাহস করতো না, কেউ মাইক ভাড়া দিতে চাইতো না, সভা করার জন্য কেউ জায়গা দিতেন না, এরকম পরিস্থিতিতে অসীম সাহসিকতায় মফিজ আলী আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে হক ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারী করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করলে সেই সময় ১৯৫৪ সালে মফিজ আলীকেও ছাত্রকর্মী হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয়, এজন্য তাঁকে ৬ মাস জেল খাটতে হয়। এ সময় জেলে তিনি কমিউনিস্ট নেতা লালা শরদিন্দু দে (বুলি দা) এর সাথে পরিচিত হন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ১৯৫৫ সালে “মুসলিম” শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তিনি আওয়ামী লীগের বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটির ২য় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের শরিক আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানকে সিয়াটো-সেন্টো চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জিরো তত্ত্বের অবতারণা করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল শক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ার বিরোধিতা করে বৃহৎ শক্তির সাথে সম্পর্কিত হওয়া তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হওয়ার উকালতি করেন এবং পাকিস্তানকে এই জোটভুক্ত করেন। পূর্ব-পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্রাজ্যবাদের উলঙ্গ দালালীর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর বক্তব্যের জবাবে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠিত হয়। এ সময় তিনি ন্যাপের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। পূর্ব-পাকিস্তান কৃষক সমিতির শুরু থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন এবং বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটি গঠিত হলে প্রথমে সহ-সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারীর পূর্ব পর্যন্ত মফিজ আলীর রাজনৈতিক কর্মস্থল ছিল সিলেট শহর। সামরিক আইন জারী হওয়ার পর তাঁকে শহর ছেড়ে জালালপুর এলাকায় এক লজিং বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। পীর হাবিবুর রহমানের সহযোগিতায় তখন তিনি জালালপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। সে কারণে তখন থেকে তাঁর নামের সাথে “মাষ্টার সাব” যুক্ত হয়, চা শ্রমিকরা তাঁকে এই নামেই সম্বোধন করতো। ১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য পদ লাভ করেন। সে সময় মফিজ আলীর পিছনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা সংস্থার লোক লেগে থাকতো। অবশেষে ১৯৬০ সালের ৭ নভেম্বর সকাল ৯ টায় জালালপুর লজিং বাড়ি থেকে মফিজ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ বছর জেল খাটেন। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর মফিজ আলীর পিতা তাঁকে সংসারে আবদ্ধ করার জন্য ১৯৬৩ সালে বিয়ে দেন। মুক্তি পাগল মানুষকে যেমন কিছুতেই আটকে রাখা যায় না, তেমনি মফিজ আলীকেও জেল জুলুম কিংবা সংসার কোন কিছুই আন্দোলন সংগ্রাম থেকে সরাতে পারেনি। যার কারণে বিয়ের বছর অর্থাৎ ১৯৬৩ সালেই তিনি শ্রীমঙ্গলের বালিশিরায় কৃষকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, যা তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বালিশিরা আন্দোলন প্রায় এক বছর জুড়ে চলে আর মফিজ আলীও তাঁর প্রায় পুরোটা সময় বালিশিরার কৃষকদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনের কারণে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়; গ্রেপ্তার, জুলুম বন্ধ হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে মার্চ মাসে প্রায় ২০ হাজার কৃষকের এক বিশাল মিছিল সিন্দূর খাল থেকে মৌলভীবাজার শহর পর্যন্ত প্রায় ২২/২৩ মাইল পায়ে হেঁটে মৌলভীবাজার হয়ে এসডিও অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

চা বাগান অধ্যুষিত শমসেরনগর এলাকায় বেড়ে উঠা মফিজ আলী শৈশবকাল থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চা শ্রমিকের দুঃখ কষ্ট, নির্যাতন নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেন। তাই যখন তিনি চা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন, তখন ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন জাতপাত; সর্বোপরি ভিন্ন সংস্কৃতির চা শ্রমিকদের নিকট মফিজ আলী খুব সহজেই তাদের একজন হয়ে উঠতে পারেন। ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল শমসেরনগরে খেদন ঠাকুরের দালানে বিপুল সংখ্যক চা শ্রমিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের সংগ্রামী সংগঠন “পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” গঠিত হয়; যা মফিজ আলীর রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত করে নতুন মাত্রা। ইউনিয়ন গঠনের পর প্রথম সর্বাত্মকভাবে ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিকরা মে দিবস পালন করে। সে সময় চা শ্রমিকদের মে দিবসের ছুটি ছিল না। ৩রা মে ১৯৬৪ চা শ্রমিকরা মহান মে দিবস উপলক্ষে শমসেরনগরে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, আসদ্দর আলী রাজা সাহেব প্রমুখ নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মে দিবসের লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শুরু হয় ইউনিয়নের কার্যক্রম। তার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ সিলেট থেকে শমসেরনগর গিয়ে মফিজ আলীর সাথে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বাগানে বাগানে ঘুরেছেন। সেই সময় মাইলের পর মাইল পায়ে হেটেই চা বাগানে তাঁদের কাজ করতে হতো।

এখানে উল্লেখ করা দরকার নাম মাত্র মজুরীতে কোন রকমে বেঁচে থাকা শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত নিপীড়িত চা শ্রমিকরা তখন মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী শ্রীহট্ট জেলা চা শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিঃ নং ৭৭ এর নিকট কার্যত জিম্মি ছিল। ১৯৪৬ সালে ভারতীয় সামন্তমুৎসুদ্দি শ্রেণির দল ভারতীয় কংগ্রেস আসাম বিধান সভার নির্বাচনে চা শ্রমিকদের জন্য সংরক্ষিত দুইটি আসনে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে গঠন করেছিল শ্রীহট্ট জেলা চা বাগান শ্রমিক কংগ্রেস। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রাম নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্যই কংগ্রেস এই সংগঠন তৈরি করেছিল। শ্রীহট্ট জেলা চা বাগান শ্রমিক কংগ্রেস পরবর্তীতে শ্রীহট্ট জেলা চা শ্রমিক ইউনিয়ন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যা বাংলাদেশ আমলে চা শ্রমিক ইউনিয়ন নামে আজও মালিকের স্বার্থরক্ষা করে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করে চলেছে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় সৎ, সংগ্রামী, শ্রেণি সচেতন নেতৃত্বে গড়ে উঠে চা শ্রমিক সংঘ। আইয়ুব খানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে জেল জুলুম সহ্য করে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে মফিজ আলী তখন সংগ্রামী জননেতায় পরিচিত। মালিক পক্ষ এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী ইউনিয়ন তাই খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিল মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিকরা সংগঠিত হলে তাদের বেপরোয়া শোষণ লুণ্ঠন কঠিন হয়ে পড়বে। মফিজ আলীর বিরুদ্ধে চলতে থাকে মালিক ও দালালদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র চক্রান্ত।

সরকার এক পর্যায়ে ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে মফিজ আলীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। শুধু তাই নয় সব ধরনের আইনগত পদক্ষেপ সম্পন্ন করে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার পরও মালিক পক্ষের চাপে সরকার ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন দেয়নি। শুরু হয় মালিকদের ষড়যন্ত্র চক্রান্তের বিরুদ্ধে চা শ্রমিকদের আন্দোলন। চা শ্রমিকদের প্রিয় নেতা মফিজ আলীর মুক্তি, সংঘের রেজিষ্ট্রেশনসহ শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে চলে আন্দোলন। কিছুদিন পর মফিজ আলী মুক্ত হলে এই আন্দোলন আরও জোরালো হয়। তিন বছর অব্যাহত আন্দোলনের কারণে ১৯৬৭ সালে চা শ্রমিক সংঘের রেজিস্ট্রেশন দিতে সরকার বাধ্য হয়, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ১২৫২। চা শ্রমিক সংঘ পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তৎপরতা চালায়। চা শ্রমিকদের সমস্যা ছিল সীমাহীন, এসব সমস্যা নিয়ে মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের আন্দোলনও চলে দুরন্ত গতিতে। আপোষহীন নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তে অটল, অনলবর্ষী বক্তা মফিজ আলী জীবনকে তুচ্ছ করে বাগানে বাগানে ঘুরেছেন শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করতে।

আপোষহীন নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে চা শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, দলে দলে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী সোলেমানের নেতৃত্বে আপোষকামী দালাল ইউনিয়ন ত্যাগ করে চা শ্রমিক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৬৭ সালের ১ জুন চা শ্রমিক সংঘের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি সরকার ও পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের নিকট পেশ করা হয়। মাসিক বেতন ১০৫ টাকা, দুই মাসের বেতনের সমান বোনাস, মাথাপিছু রেশন ৫ সের, বেকার শ্রমিকের কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জলের সুব্যবস্থা, ইউনিয়ন করার অধিকার ইত্যাদি দাবি ছিল ৯ দফাতে। ৯ দফা দাবিতে বাগানে বাগানে সভা, সমাবেশ মিছিলের মাধ্যমে চলে ব্যাপক প্রচার তৎপরতা। মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিক সংঘের দুর্বার অগ্রযাত্রা মালিক পক্ষ ও দালাল ইউনিয়নের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। আবারও শুরু হয় মালিক পক্ষ ও দালাল গোষ্ঠীর সমন্বিত ষড়যন্ত্র চক্রান্ত এবং আক্রমণ। সিরাজনগর চা বাগানে মফিজ আলীকে আক্রমণ করার জন্য ভাড়া করা হয় সন্ত্রাসী দই আলী ও তুষান গ্যাংদের আর শমসেরনগর চা বাগানে ইংরেজ ম্যানেজার মফিজ আলীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলার হাজিরার দিন বিভিন্ন বাগানের প্রায় ১০ হাজার চা শ্রমিক শমসেরনগরে সমবেত হয়ে পায়ে হেঁটে মিছিল করে মৌলভীবাজার যাত্রা করে এবং কোর্ট প্রাঙ্গণে শিশু পার্কে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মিছিলের সংবাদ পেয়ে আদালত অগ্রিম মফিজ আলীর জামিন দেন।

১৯৬৭ সালে মফিজ আলীর বাড়ির নিকটে এসে রেলগাড়ি থামিয়ে দুই প্লাটুন রিজার্ভ পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মফিজ আলীর গ্রেপ্তারের সংবাদ চা বাগানে পৌঁছা মাত্রই শুরু হয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ক্ষোভ বিক্ষোভ, তারপর ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে ৬ মাস পর মফিজ আলীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণির দাবি আদায়ের আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ পেলে চা বাগানেও তার প্রভাব পড়ে। এ সময়ে ’৬৯ সালে সামরিক আইন জারীর পর শমসেরনগর চা বাগানে শ্রমিকরা দাবি আদায়ে ম্যানেজারকে ঘেরাও করে আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ এসে শ্রমিকের উপর গুলি চালান। পুলিশের গুলিতে নীরা বাউরী নামের এক শ্রমিক নিহত হন। শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের এই ঘটনায় বাগানের ম্যানেজার চা শ্রমিক সংঘের নেতা মফিজ আলী ও সীতারাম বার্মার নামে সামরিক আদালতে মামলা দায়ের করে। এসময় থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন থাকেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর শেখ মুজিবের সরকার তাঁকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে। এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তান আমলের এ জাতীয় মামলা বাংলাদেশ সরকার খারিজ করলেও প্রগতিশীল বামপন্থী নেতা মফিজ আলীকে তারা রেহাই দেয়নি।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই জননেতা জীবনে ৭ বার জেল খাটেন। তার মধ্যে ১৯৬৫ সালে ডিসেন্ট রোলস অব পাকিস্তান আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা পাকিস্তান কারাগারে এক বছর আটকে রাখা হয়। সেসময় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, নানকার আন্দোলনের নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নিকট হতে তিনি মার্কসবাদ সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হন। যার কারণে মফিজ আলী কমরেড অজয় ভট্টাচার্যকে তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু বলে স্বীকার করতেন। কমরেড অজয় ভট্টাচার্য তাঁর “কুলিমেম” উপন্যাস মফিজ আলীর নামে উৎসর্গ করেন।

মফিজ আলীর রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় ছাত্রজীবনেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির ধারাতে সম্পৃক্ত হন এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কৃষক সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির ধারাতে ১৯৬০ সালে পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য পদ লাভ করেন। সে সময় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে দেখা দেয় মতাদর্শগত সংগ্রাম। ১৯৫৩ সালে কমরেড স্টালিনের মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ চক্র তিন শান্তির তত্ত্ব তথা “শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান” “শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা” ও “শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ” এর সংশোধনবাদী তত্ত্ব তুলে ধরে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালে ২২তম কংগ্রেসে সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ চক্র আরও অগ্রসর হয়ে সর্বহারা শ্রেণির পার্টি এবং সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের মতবাদ বাতিল করে “সর্ব জনগণের পার্টি” ও “সর্ব জনগণের রাষ্ট্র” সংশোধনবাদী তত্ত্ব হাজির করে। ফলশ্রুততে সারাবিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে শুরু হয় মহাবিতর্ক, আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ে। মনি সিং এর নেতৃত্বে একাংশ সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ তত্ত্বে¡র পক্ষাবলম্বন করে এবং অপরাংশ কমরেড আবদুল হক, মোঃ তোয়াহা, অজয় ভট্টাচার্য, সুখেন্দু দস্তিদার মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মতাদর্শগত লড়াই চালান, এই অংশকে চীনপন্থি হিসাবে অনেকে চিত্রিত করেন। ফলে ১৯৬৫ সালে পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে মফিজ আলী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে অবস্থান নেন।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রশ্নে পার্টি আবারও বিভক্ত হয়। দুই পরাশক্তি রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাজার, প্রভাব বলয় ও আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বাঙালী মুৎসুদ্দি শ্রেণির সাথে পাকিস্তান মুৎসুদ্দি শ্রেণির স্বার্থের দ্বদ্ব সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সৃষ্টি করে। কমরেড আবদুল হকের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ সকল জাতিসত্তাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে সকল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে ’৭১ সালের যুদ্ধকে মার্কিন-রুশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলাফল হিসেবে মূল্যায়ন করেন। অপরাংশ সুখেন্দু দস্তিদার, মো. তোয়াহার নেতৃত্বে উগ্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভেসে গিয়ে ’৭১ সালের যুদ্ধকে “মুক্তিযুদ্ধ” আখ্যায়িত করে। বাংলাদেশ আমলে এই অংশের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল (এমএল) গঠিত হলে লালা শরদিন্দু দে’র (বুলিদা) মাধ্যমে মফিজ আলী সাম্যবাদী দলে যোগদান করেন এবং সাম্যবাদী দলের মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে প্রথমে খন্দকার মোস্তাক, পরে সায়েম এবং অবশেষে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে হারানো স্বর্গ পুনরুদ্ধার করে; কার্যকর করে নয়া উপনিবেশিক আধাসামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা। সাম্যবাদী দল মার্কিনের দালাল জিয়াউর রহমান সরকারকে “দেশ প্রেমিক সরকার” আখ্যায়িত করে ১৯৭৭ সালে পলিটিকাল পার্টি রেগুলেশন (পিপিআর) এ নিবন্ধিত হয়। মফিজ আলী ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাম্যবাদী দলের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। সাম্যবাদী দলের লাইনকে সংশোধনবাদী অনুধাবন করে তিনি ১৯৭৯ সালে জেলা সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পত্র দেন। এভাবে সাম্যবাদী দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯৮০ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৮১ সালে মার্কিনের দালাল সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতাসীন হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করে। এ সময় প্রবীণ নেতা হাজী দানেশ ও জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) এর নেতা সিরাজুল হোসেন খান (মফিজ আলীর এক সময়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) জাতীয় পার্টির নেতা ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হয়ে মফিজ আলীর নিষ্ক্রিয়তা ও হতাশাকে কাজে লাগিয়ে চা শ্রমিকদের কিছু দাবি দাওয়া পূরণ ও চা শ্রমিক সংঘের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করান। ১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি সরকারী দল, সরকার, নির্বাচনের প্রতিক্রিয়াশীল স্বরূপ হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে অতি দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ’৮৮ সালের পর জাতীয় পার্টি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে কার্যত সম্পর্ক রাখেননি। এ সময়ে তার লিখিত কবিতায় তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ধারাতে ১৯৮৮ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়। সে সময় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম-আহবায়ক এডভোকেট ই ইউ শহিদুল ইসলাম মফিজ আলীকে গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকা পাঠাতেন। সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক গভীর হয়ে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সম্পর্কের ধারাতে মফিজ আলী ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, সাম্যবাদী দলের সংশোধনবাদী লাইন এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনৈতিক দল ও সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা সারসংকলন ও পূণঃমূল্যায়নের মাধ্যমে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করে ৭১ পূর্ব রাজনৈতিক জীবনকে পুনরুদ্ধার এবং আমৃত্যু শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের পক্ষে আত্মনিবেদন করার প্রত্যয়ে ১৯৯৩ সালে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এ যোগদান করেন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সংগঠক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমৃত্যু তিনি সংগঠন সংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। একই সাথে তিনি ফ্রন্টের শরিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি হিসাবে চা রাবার, হোটেল, রিক্সা, দর্জি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি চা শ্রমিকদেরকে পুনরায় বিপ্লবী ধারায় সংগঠিত করার জন্য চা শ্রমিক সংঘ গড়ে তোলাসহ চা ও রাবার শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রাম পুনর্গঠিত করায় আত্মনিয়োগ করেন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর এই নব উদ্যোগ চা শিল্পে আপোষহীন সংগঠন সংগ্রামের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এ প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে চা শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে তিনি আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অসমাপ্ত কাজ প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন, চা শ্রমিক, শ্রমিক শ্রেণিকে অগ্রসর করে সফল করার মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে।

তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি এদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিপ্লবী বিকাশ ধারাতে সম্পৃক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যখন তাঁর আত্মউপলব্ধি হয়েছে তখন তিনি তাঁর সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান ত্যাগ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। এদেশের জনগণের মূল শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি। তিনি মনে করতেন শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। সে লক্ষ্যে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শ্রমিক কৃষককে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করেন।

মফিজ আলীর জীবনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শ্রমিক কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি দাওয়া নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা চালান। তিনি ইংরেজি ডন, বহুল প্রচারিত সংবাদ, ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক জনতা, লালবার্তা প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। এছাড়াও তাঁর প্রবন্ধ, লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ম্যাগাজিন, স্মারকগ্রন্থ ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও তাঁর অনেক লেখা অপ্রকাশিত আছে। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক বইয়ের অনুবাদ করেছেন, যেগুলো ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে আশা করা যায়।

মফিজ আলী আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন সংগ্রাম আমাদের পাথেয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী বিকল্প ধারার সংগঠন ও তার নেতাকর্মী এবং জনগণকে এই মহান নেতার অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে অকুতোভয়ে অগ্রসর হতে হবে। জাতীয় ও জনজীবনের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে মফিজ আলীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসক শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে মফিজ আলীর অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব।

মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামী এই জননেতা ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

  • অনন্য আদিত্য: রাজনৈতিক কর্মী। ইমেইল: [email protected]
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত