লিটন দেব জয়

১৭ মে, ২০২১ ১০:২৫

বোমান-রাজকুমার ও মুন্না ভাই এমবিবিএসের গল্প

নব্বই দশকের শেষের দিকের ঘটনা। পরিচালক রাজকুমার হিরানি তখন এড ফিল্ম বানান। অনেক সময় নিজেই সেসব এডে মডেল হিসেবে ক্যামেরাবন্দি হন। পাশাপাশি সিনেমা সম্পাদনার কাজ করেন৷

বোমান ইরানি হ্যান্ডিক্যামে শুট করা এক ইংরেজি মুভিতে অভিনয় করছিলেন তখন। ক্যামেরার সামনে কাজ কম করলেও মঞ্চে তখন বেশ নামডাক শুরু হয়েছে বোমান ইরানির। থিয়েটারে 'ফ্যামিলি টাইস' এ অভিনয় করেছেন। 'মহাত্মা ভার্সেস গান্ধি'-তে গান্ধি চরিত্রে অভিনয়ে বেশ সুনাম কুড়ান। তবে মঞ্চে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন 'আই এম নট বাজিরাও' দিয়ে। লাগাতার দশ বছর মঞ্চস্থ হয়েছিলো সেটি।

তৎকালীন সময় হ্যান্ডিক্যামে শুট করা সেই ইংরেজি ছবিটি এডিটের সময় দেখেন রাজকুমার হিরানি৷ বোমানের অভিনয় দেখেই মনে মনে ঠিক করে ফেলেন এই অভিনেতার সাথে যেভাবেই হোক কাজ করতে হবে। কিন্তু তিনি যেসব এড ফিল্ম বানান সেখানে তো আর বোমান ইরানি অভিনয় করবেন না। শেষমেশ ভাবলেন মুভিই বানাবেন তিনি। সেখানে বোমানকে দিয়ে অভিনয় করাবেন।

একদিন প্রযোজক বিধু বিনোদ চোপড়ার অফিসে বোমান ইরানির সাথে দেখা হয় রাজকুমার হিরানি'র। বোমানের সাথে পরিচয় হবার এক পর্যায়ে তাঁর হাতে দুই লক্ষ রুপির চেক দিয়ে দেন। বোমান বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'এটা কিসের চেক?' রাজকুমার বললেন, 'আপনার সাথে একটা মুভি বানাবো সেটার সাইনিং এমাউন্ট!' বোমান জিজ্ঞেস করলেন, 'কিসের মুভি, স্ক্রিপ্ট কোথায়?' রাজকুমার জানালেন, 'এখনও স্ক্রিপ্ট লেখা হয়নি। কাহিনীও নাই। তবে হয়ে যাবে।'

এভাবে আরও বছরখানেক কেটে গেলো। একদিন রাজকুমার ফোন দিলেন বোমানকে। রাজকুমার বললেন, 'আপনার মুভির স্ক্রিপ্ট রেডি। একদিন শোনাতে আসবো বাসায়।' বোমান জিজ্ঞেস করলেন, 'মুভির নাম কী? আমি কোন চরিত্রে অভিনয় করবো?' রাজকুমার জানালেন, 'মুভির নাম মুন্না ভাই এমবিবিএস। আপনি মেডিকেল কলেজের ডিনের চরিত্রে অভিনয় করবেন। খুব মজার চরিত্র। ডিন রাগ উঠলে হাহা করে হাসে।' সিনেমার নাম 'মুন্না ভাই এমবিবিএস' শুনেই হাসি শুরু করেন বোমান। বললেন, 'ভাই মাফ করেন আমাকে। আপনার টাকাটা ফেরত নিয়ে যান। আমি এসব মুভিতে অভিনয় করবো না।' রাজকুমার বললেন, 'স্ক্রিপ্ট পড়ে পছন্দ না হলে আমি জোর করবো না। একবার স্ক্রিপ্টটা শুনেন! তবে শর্ত হচ্ছে আমি নিজে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাবো আপনাকে। '

বোমান ভাবলেন এটাই ভালো সুযোগ। স্ক্রিপ্ট শুনেই না করে দেয়া যাবে। বললেন, 'ঠিক আছে৷ বাসায় আসেন একদিন।' রাজকুমার বোমানের বাসায় গেলেন। চার পাঁচ ঘণ্টা লাগলো স্ক্রিপ্ট শোনাতে। এতো সময় বোমান জায়গা থেকে উঠলেন না। মুগ্ধ হয়ে শুনলেন পুরো স্ক্রিপ্ট। ভাবলেন, এই লোক যে রকম গল্পটি উপস্থাপনা করেছে তার ১০ ভাগও যদি সিনেমায় তুলে আনতে পারে তাহলে এটা সুপারহিট সিনেমা হবে। রাজি হয়ে গেলেন বোমান।

কিছুদিন পর রাজকুমার হিরানি'র অফিসে গেলেন বোমান ডক্টর জে সি আস্তানা চরিত্রের গেটআপ নিয়ে। মাথা পুরোটাই ন্যাড়া। সাইডে কিছু চুল। একেবারে চেনা যাচ্ছিলো না তাঁকে। রাজকুমার হিরানি কিছুক্ষণ পর অফিসে এসে বললেন, 'আজ বোমান ইরানি আসতে পারেন। আসলে আমাকে নক দিয়ো।' বোমান তখন তাঁর কাছাকাছিই বসে ছিলেন। একদম চিনতে পারলেন না তাঁকে এই গেটআপে। যখন চিনলেন তখন বিস্ময় যেন কাটছেই না রাজকুমার হিরানি'র।

মুন্না ভাই এমবিবিএস সিনেমা নির্মিত হলো। বাকিটা তো ইতিহাস। বক্স অফিসে ঝড় উঠলো। ১০ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমা আয় করে নিলো ৯৩ কোটি রুপি। বলিউড দেখলো মুগ্ধকর এক অভিনেতা বোমান ইরানিকে। পাশাপাশি সার্কিট চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় চলে আসলেন আরশাদ ওয়ার্সি।

ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা দিয়ে বাজিমাত করে দিলেন রাজকুমার হিরানি। পরের গল্প তো সবারই জানা। 'লাগে রাহো মুন্না ভাই, 'থ্রি ইডিয়স', 'পিকে', 'সঞ্জু' দিয়ে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন রাজকুমার হিরানি। বনে গেলেন বলিউড ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক নির্মাতা। তুখোড় অভিনয় শৈলী দিয়ে বোমান ইরানিও রচনা করলেন নিজস্ব এক মহাকাব্য। যে মহাকাব্যে সাধারণ দর্শক থেকে সমালোচক সবার প্রশংসাবাক্য ঝরে অবিরাম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত