মহাকাব্যিক পরশ পাথর হুমায়ূন আহমেদ

 প্রকাশিত: ২০২০-১১-১৩ ২০:২৬:৫৭

লিটন দেব জয়:

উত্তাল একাত্তর। প্রাণ হারানোর আর্তনাদ চারদিকে। সবুজ এই বদ্বীপ তখন মৃত্যুপুরী। পৈশাচিক দিনলিপির আরেক পৃষ্ঠা যোগ করতে একদল বাঙালি ধরা পড়লো পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। বিভিন্ন বয়েসি মানুষের সাথে সেখানে ছিলো এক যুবক। যুবকটির চোখে চশমা, স্বপ্নরাঙা অদ্ভুত মায়াময় তাঁর দৃষ্টি। কিন্তু পশুগুলোর সেই চোখ দেখে মায়া হলো না। তাঁর মাথায় তুলে দেয়া হলো গোলা-বারুদে ভর্তি ভারী একটি বস্তা।

কয়েক মাইল হাঁটার পর ক্যাম্পে আসলো সবাই। হঠাৎ করে পাকিস্তানি কমান্ডার লাইনে দাঁড়াতে বললো আটক সবাইকে। লাইন তৈরি হওয়া মাত্রই আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে গুলি ছোড়া হলো। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো সবাই। সবুজ প্রান্তর ভেসে গেলো রক্তগঙ্গায়। সেই রক্তগঙ্গায় রক্তস্নানের পর অলৌকিকভাবে সেদিন বেঁচে যায় যুবকটি। শুরু হয় নতুন এক জীবন। সেই যুবকটি আর কেউ নন। তিনি নন্দিত কথাসাহিত্যিক, কিংবদন্তি নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদ কলমকে জাদুর কাঠি বানিয়ে চালিয়েছেন জাদুকরের মতো। তাঁর কলমের ছোঁয়ায় শৈল্পিক রূপ পেয়েছিলো উপেক্ষিত বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সহজ-সরল ভাষায়, অনবদ্য বর্ণনায়, সূক্ষ্ম হাস্যরসে অসংখ্য পাঠক মোহগ্রস্ত হয়ে ছিল সুদীর্ঘকাল। বাংলাদেশের লেখালেখির ইতিহাসে এরকম তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা জুটেনি আর কোন লেখকের কপালে। শুধু লেখালেখি বললে ভুল হবে! নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীতেও সোনা ফলিয়েছেন তাঁর জাদুকরী হাতের স্পর্শে।

'কোথাও কেউ নেই' নাটক তুমুল জনপ্রিয় তখন। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'কোথাও কেউ নেই নাটক রচনার পেছনের গল্পটি কী?' হুমায়ূন আহমেদ উত্তরে বললেন, 'মেয়েরা একটা টেলিভিশন চেয়েছিলো। কিনে দিতে পারিনি। শুনলাম নাটক লিখলে বেশ টাকা পয়সা পাওয়া যায়। টেলিভিশন কেনার টাকা জোগাড় করতে নাটকটি লিখেছিলাম'। সাংবাদিক নিশ্চয়ই বিস্ময়ে হা করে ছিলেন উত্তর শুনে! ঘটনাটি জেনে আমিও ঘোরের মধ্যে ছিলাম। টেলিভিশন কেনার টাকা জোগাতে লিখে ফেললেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা নাটকটি? আহা হুমায়ূন আহমেদ!

বাংলা নাটকে হুমায়ূন রীতিমতো যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। 'কোথাও কেউ নেই', 'অয়োময়', 'এইসব দিনরাত্রি', 'আজ রবিবার' নাটকগুলো কালজয়ী সৃষ্টি৷ নাটকে তোলপাড় তুলে আসলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। সৃষ্টি করলেন 'আগুনের পরশমণি', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'চন্দ্রকথা', 'শ্যামল ছায়া', 'ঘেটুপুত্র কমলা'। সংগীতের ভুবনকেও সমৃদ্ধ করলেন নিজস্ব কারিশমায়।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক মহাকাব্যিক পরশ পাথর। যে সব ক্ষেত্র তাঁর স্পর্শ পেয়েছে সোনা-ই ফলেছে। আমাদের ভাগ্য আসলেই সুপ্রসন্ন। কারণ বাংলাদেশে জন্মেছিলেন আপনি। গর্ব ভরে বলার সুযোগ দিয়েছিলেন 'আমাদের হুমায়ূন আহমেদ।' আজন্ম আপনার শিল্পসৃষ্টির ঋণী থাকতে হয়ে থাকতে চাই আমরা।

শুভ জন্মদিন শৈল্পিক জাদুকর।

আপনার মন্তব্য