বিনোদন ডেস্ক

২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:৫৩

‘বেলাশেষে’র গল্প

যে শিল্প একই সাথে মানুষকে হাসাতেও পারে কাঁদাতেও পারে সে শিল্পই বোধহয় প্রকৃত শিল্প। মানুষের সকল অনুভূতির ঘরে একবার করে কড়া নাড়তে পারার মধ্য দিয়েই বোধহয় প্রকৃত শিল্পের সার্থকতা।

নকল, রিমেক আর স্থুলতার ভীড়ে বাংলা চলচ্চিত্র যেখানে ভগ্নপ্রায় তখন ওপার বাংলায় তরুণ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্রকার এসবের মাঝেও আলাদা করে নিজের জাত চিনিয়ে চলছেনে ক্রমাগত। নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জুটি তাদেরই অন্যতম। তারা নায়ক-নায়িকা জুটি নন, তারা পরিচালক জুটি। বাংলা চলচ্চিত্রে এও এক অভিনব ব্যাপার।

পরিচালক হিসাবে যাত্রা শুরুর সময় থেকেই  সারল্যভরা গল্প উপস্থাপনে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছেন তারা।  ‘ইচ্ছে' দিয়ে যে উড়ালের শুরু তা ‘মুক্তধারা', ‘অ্যাক্সিডেণ্ট', ‘অলীকসুখ', ‘রামধনু' পেরিয়ে পূর্ণতার ডানা বিস্তার করেছে ‘বেলাশেষে'-তে এসে৷

বেলাশেষে ছবির কাহিনিতে প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাহিত্যপ্রেমী বিশ্বনাথ মজুমদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) দুর্গাপুজো উপলক্ষে ছেলে (শংকর চক্রবর্তী), ছেলের বউ (ইন্দ্রাণী দত্ত), তিন কন্যা (অপরাজিতা আঢ্য, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও মনামি ঘোষ) এবং তিন জামাইকে (খরাজ মুখোপাধ্যায়, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) এক জায়গায় জড়ো করেন৷ সকলে ভাবে উনি বোধহয় উনার উইল পড়ে শোনাবেন৷ কিন্তু বিশ্বনাথ সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানান, ৪৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানতে চান তিনি৷ স্ত্রী আরতির (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) সঙ্গে ডিভোর্সের জন্য যাবতীয় আইনি ব্যবস্থা তিনি ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন৷ কিন্তু কেন? দু'জনের দাম্পত্য জীবনে কোনও বিবাদ নেই৷ কোনও অপূর্ণতাও নেই৷ তাহলে?

আদালত দু'জনের সেপারেশন টাইমে ১৫ দিন একত্রে কাটাতে বলে৷ সেই সময়কালে কী হয়? সবকিছু জানতে হলে একবার অবশ্যই ছবিটা দেখে ফেলতেই হবে৷ তরুণ মজুমদারের পর এমন মর্মস্পর্শী পারিবারিক ছবি উপহার দিতে দেখা যায়নি কোনও বাঙালি পরিচালককে৷

আজকের বাংলা ছবি হয় শিকড়হীন সস্তা বিনোদন দিতে রিমেকের শরণাপন্ন্ হয়৷ আর তা না হলে আঁতলামির চূড়ান্ত করে মুষ্টিমেয় কিছু শহুরে দর্শকের ভিতর ঘুরপাক খায়৷

‘বেলাশেষে' এর মাঝামাঝি এক অন্যধারার কথা বলে, যা খাঁটি বাঙালিয়ানায় সমৃদ্ধ৷ আবার দর্শককে বিনোদন দিতেও কার্পণ্য করে না৷ তাই অজান্তেই হেসে বা কেঁদে ফেলতে হয় ছবি দেখতে দেখতে৷

ভাবতে বসলে উপলব্ধি হয়, এ যাবত্‍ নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটি তাঁদের পূর্ববর্তী ছবিগুলিতে সামাজিক অনেক সমস্যায় আলোকপাত করেছেন ঠিকই৷ তবে, দর্শক হৃদয়ের গভীরে  সেঁধিয়ে যাওয়া এবং থেকে যাওয়ার ব্যাপারটা ‘বেলাশেষে' ছবিতে মসৃণভাবে সম্পন্ন্ হয়েছে৷

গোপী ভগতের ক্যামেরা তাই বাড়তি কেরামতি দেখিয়ে গল্পের গতিকে বিঘ্নিত করেনি। ক্যামেরা অহেতুক লাফালাফি করেনি, শান্ত থেকেছে৷ ফলে দর্শক ছবিতেই মনোনিবেশ করেছেন৷

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং অনুপম রায়ের কম্পোজ করা গানগুলি শ্রুতিমধুর এবং ছবিতে যথাযথভাবে ব্যবহৃত৷ বিনিতরঞ্জন মৈত্র-র আবহসঙ্গীতও বাড়াবাড়ি করেনি৷ কানে পীড়া দেয়নি৷ মিশে গিয়েছে দৃশ্যের সঙ্গে।


সৌমিত্র, স্বাতীলেখা-র ‘ঘরে বাইরে' জুটিকে পরিণত বয়সে এমন কেন্দ্রীয় চরিত্রে পাওয়াটা সত্যিই অভাবনীয়।  সৌমিত্র তো দারুণ। কিন্ত্ত সিনেমায় নিয়মিত অভিনয় না করা স্বাতীলেখাও এত সহজে চরিত্রের সারল্যকে অভিনয়ে তুলে ধরেছেন যে ভাবলে শিহরিত হতে হয়৷ বাকিদের মধ্যে খরাজ মুখোপাধ্যায় এবং অপরাজিতা আঢ্য জুটি তাঁদের চরিত্রের সংলাপ ও অ্যাকটিভিটির গুণে দর্শকদের সারাক্ষণ মাতিয়ে রেখেছেন৷ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও অত্যন্ত সাবলীল৷ মনামী, অনিন্দ্য এমনকী সুজয়প্রসাদ ও শিশু শিল্পীরাও চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে অভিনয় গুণে।

চিত্রনাট্য ও সংলাপে জীবন থেকে নেওয়া এত রসদ যে কখনওই তা দর্শককে বিরক্ত করে না।  প্রায় আড়াই ঘণ্টার কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের ছবি তাই কখন সমাপ্তিতে পৌঁছে যায়, বোঝাই যায় না৷ এমনকী ‘এন্ড ক্রেডিটস' না দেখে বেরিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই, কারণ ফ্রেমে তখনও ছবির হ্যাপি এন্ডিং চলছে।


-প্রতিদিন









আপনার মন্তব্য

আলোচিত