২০শে অগাস্ট, ১৯৭১ …একটা তাবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন

০৫ জুন, ২০১৫ ১৬:৪৮

আজম খান: সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা আর পপসম্রাট

পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সাথে লড়াই করে ৫জুন গুরু আজম খানের ৪র্থ মৃত্যুবাষির্কী। ৫ই জুন, ২০১১ইংরেজি, রবিবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলা পপ সঙ্গীতের কিংবদন্তী নাম আজম খান। মানুষটিকে তরুণ সমাজ চেনে ‘পপ সম্রাট’ হিসেবে, জানে সবাই ‘গুরু’ নামে। বাংলা পপ সঙ্গীতের এক নক্ষত্র আজম খান। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান।

পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সাথে লড়াই করে ৫জুন গুরু আজম খানের ৪র্থ মৃত্যুবাষির্কী। ৫ই জুন, ২০১১ইংরেজি, রবিবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আজম খান ১৯৫০ সালে আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মা জোবেদা খাতুন। সেখানে তারা ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। তার বাবা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎক ছিলেন। তার তিন ভাই ও এক বোন ছিল। বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজো ভাই আলম খান (সুরকার), ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম।

১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর দুই-এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুনরায় আগরতলায় ফিরে আসেন।

এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান।

তন্মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত অপারেশান তিতাস। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল), হোটেল পূর্বাণী'র গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়।

আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান।

১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দু'টি সরাসরি প্রচার হলো প্রচার হলো। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দু'টো গান।

১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তার মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা।

১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ৩১ বছর বয়সে তিনি ঢাকার মাদারটেকে সাহেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান এবং দ্বিতীয় সন্তানের 'হৃদয় খান' এবং তৃতীয় সন্তানের নাম অরণী খান। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন তার। আজম খান দুই মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। এছাড়া আছেন চার ভাই ও এক বোন।

১৯৯১—২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন। তিনি ‘গডফাদার’ নামক একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেন। 

পুরো নাম: মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান।
জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০।
জন্মস্থান: ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনি, ঢাকা।
স্কুল: ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। কলেজ: ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।
পেশা: সংগীতশিল্পী।
বিশেষত্ব: দেশপ্রেমিক ও মানবদরদি, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা পপসংগীতের জনক।
উপাধি: পপসম্রাট আজম খান, কিংবদন্তি আজম খান, গুরু নামে খ্যাত।
মায়ের নাম: মৃত জোবেদা খানম।
বাবার নাম: মৃত মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান।
বাবার পেশা: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন।
আযম খানের বিয়ে: ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর।
স্ত্রীর নাম: সাহেদা বেগম।
প্রথম সন্তান: ইমা খান।
নাতনি: কায়নাত ফাইরুজ বিনতে হাসান।
দ্বিতীয় সন্তান: হৃদয় খান।
তৃতীয় সন্তান: অরণী খান।
ঠিকানা: ২ নম্বর কবি জসীমউদ্দীন রোড, কমলাপুর, ঢাকা-১২১৭।
বড় ভাই: সাইদ খান।
পেশা: সরকারি চাকরিজীবী।
মেজো ভাই: আলম খান।
পেশা: গীতিকার ও সুরকার।
ছোট ভাই: লিয়াকত আলী খান। মুক্তিযোদ্ধা।
পেশা: ব্যবসায়ী।
ছোট বোন: শামীমা আক্তার খানম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত