সিলেটটুডে ডেস্ক

২৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০১:৪৯

যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডে পাকিস্তানে আহাজারি অব্যাহত

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের সব আদালত থেকে দোষী প্রমাণিত শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের পর থেকে পাকিস্তানে আহাজারি অব্যাহত রয়েছে।

ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় শুধু পাকিস্তানের সরকারই নয়, সে দেশের বিভিন্ন দল ও পত্র-পত্রিকাগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।

পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাদের), জামায়াতে ইসলামী ও পাক মুসলিম অ্যালায়েন্সসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা দুজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং নিন্দা জানিয়েছেন।

ফাঁসির প্রতিবাদ করে পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে একটি প্রস্তাব এনেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করার জন্য এতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

এদিকে দ্য ডন, ডেইলি টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকার খবর ও সম্পাদকীয়তে বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

দুজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর রোববার পাকিস্তান সরকার এক বিবৃতিতে 'গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ' প্রকাশ করে। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, ''গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এতে আমরা খুবই অসন্তুষ্ট।

১৯৭১ সালের ঘটনাবলি (মহান মুক্তিযুদ্ধ) নিয়ে বাংলাদেশে যে 'ত্রুটিপূর্ণ' বিচার চলছে সে বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি এবং এ নিয়ে আগের মতো আবারও গুরুত্ব দিচ্ছি।''

এ দিনই সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান ফাঁসি কার্যকর হওয়ার বিষয়টিকে 'ন্যায়বিচার হত্যা' বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। দুই দেশের জনগণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়, কিন্তু বাংলাদেশে একটি 'গ্রুপ' বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তা ইতিহাসের খুবই নিন্দনীয় অধ্যায়। তবে তা ভুলে যাওয়া উচিত। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। অতীতের তিক্ততা ভুলে দুই দেশের জনগণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যেতে চায়।

তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষ করে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নীরবতায় তিনি বিস্মিত।

ডেইলি টাইমসের অনলাইন খবরে বলা হয়, সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহিরক-ই ইনসাফ পার্টির পক্ষ থেকে সোমবার পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত আছে। পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি সমর্থনকারীদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করা প্রয়োজন।

এদিন ডেইলি টাইমসের ছাপা সংস্করণে 'পাকিস্তান পাটারবড বাই বাংলাদেশ এক্সিকিউশনস' শিরোনামে খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে দুজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় পাকিস্তান 'খুবই উদ্বিগ্ন'।

এ নিয়ে ইসলামাবাদের দেওয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে।

দ্য নিউজের খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর প্রধান সিরাজুল হক রোববার এক সমাবেশে বক্তৃতায় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির নিন্দা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, এটি পাকিস্তানের জন্য 'কালো দিবস'। এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের নীরবতা ভাঙা উচিত। মুজাহিদের একমাত্র অপরাধ হচ্ছে পাকিস্তানকে সমর্থন করা। পুরনো বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে সমাবেশে মুজাহিদকে 'পাকিস্তানের সাচ্চা বন্ধু' অভিহিত করেন তিনি। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল পাকিস্তানের জামায়াত।

পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাদের) মহাসচিব মুশাহিদ হোসেন সাঈদ দু'জনের ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার ভালো বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে।

দ্য ডন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পাচ্ছে বলে এতে মন্তব্য করা হয়।

এর আগেও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তান বিরূপ সমালোচনা করেছে। এমনকি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর রোববার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডনের অনলাইনে 'ঢাকা সামনস পাকিস্তানি এনভয়, লজেস প্রটেস্ট ওভার ফরেন অফিস স্টেটমেন্ট' শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে নিয়ে প্রতিবাদ জানানোয় দুই দেশের সম্পর্কে আরেকটি আঘাত এলো।

এদিকে পুরো পাকিস্তান যখন তাদের 'সাচ্চা দোস্ত' সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের পক্ষে সরব তখন কিছুটা হলেও স্রোতের বিপরিতে হেঁটেছেন মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর।

তাকে উদ্ধৃত করে দেশটির ইংরেজি দৈনিক ডন লিখেছে, “সরকার এই আচরণের মাধ্যমে শুধু এটাই প্রমাণ করল যে, বাংলাদেশে যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তারা আসলে ছিল রাজনৈতিক চর, তারা কাজ করছিল পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য।” সোমবার ইসলামাবাদ হাই কোর্টে সাংবাদিকদের সামনে নিজের এই মতামত তুলে ধরেন আসমা জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বা সৌদি আরবে অন্যায্যভাবে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলে সরকারকে ‘এতোটা উতলা হতে’ দেখা যায় না, যতোটা বাংলাদেশের বিরোধী দলের দুই রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে দেখা গেল।

তবে ডন লিখেছে, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের বিচারের ক্ষেত্রে ‘সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি’ বলে আসমা নিজেও বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, এই ফাঁসি বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়িয়ে দেবে’।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত