সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ জুলাই, ২০১৬ ২৩:৪১

তুরস্ককে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ বানাতে চান এরদোয়ান!

তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছে দেশটির জনগণ। এই দাবিতে রাস্তায় নেমে স্লোগানও দিচ্ছে অনেকে। আর এতে অনেকে ধারণা করছেন, এক সময়ের ‘সেক্যুলার‘ তুরস্ক ধীরে ধীরে পুরো মাত্রায় ইসলামিকরণের দিকে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এরদোয়ানের পুরোপুরি অনুসারি নয়, অভ্যুত্থান চেষ্টার সুযোগে তাদের সরিয়ে দেয়ার একটি বৈধতাও তিনি পেয়ে গেলেন।

তবে কি তুরস্কের সমাজকে ইসলামিকরণের জন্য সর্বময় ক্ষমতার একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছেন এরদোয়ান! উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর এরদোয়ানের মতো ক্ষমতাশালী শাসক আর তুরস্কের ক্ষমতায় আসেন নি। এরদোয়ান ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘বিদ্রোহী সেনারা যা করেছে, তার জন্য তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। এই অভ্যুত্থান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেশবাসীর জন্য উপহার। কারণ এটি আমাদের সেনাবাহিনী আবার ঢেলে সাজানোর একটি উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে।’

অভ্যুত্থান চেষ্টার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার পুলিশ, ৩০ জন গভর্নর এবং ৫২ জন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ৭০ জন অ্যাডমিরাল ও জেনারেল মর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা, ৩ হাজার সৈনিক এবং ২ হাজার ৭০০ বিচারককে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অভ্যুত্থানের সময় যখন ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে বিদ্রোহী সেনারা সাধারণ লোকদের হাতে আটক হচ্ছিল, তখন সাধারণ লোকেরা রাস্তায় ‘আল্লাহু আকবার’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল এবং তারা কোরানের বিভিন্ন আয়াত জোরে জোরে পাঠ করছিল। তাছাড়া এরদোয়ানের পক্ষে রাস্তায় নামার জন্য তুরস্কের ৮৫ হাজার মসজিদ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। এটাও অভ্যুত্থান রুখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

৩ বছর আগেও ইস্তাম্বুলের যে গেজি পার্ক এরদোয়ান-বিরোধী সেক্যুলারদের কেন্দ্র ছিল তা এখন দখলে। ইসলামপন্থীদের এসব কর্মকাণ্ড ইস্তাম্বুলের মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। সেক্যুলার মতাদর্শে বিশ্বাসী ইস্তাম্বুলের ২৬ বছর বয়সী নারী ব্যবসায়ী সেলিন দেরিয়া বলেন, ‘অভ্যুত্থান চেষ্টার পর এরদোয়ানপন্থীরা যখন সিটি সেন্টারে জড়ো হচ্ছিল তখন আমি আমার পোশাক নিয়ে বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। তারা এ ধরনের আটসাট পোশাক, স্কার্ট এগুলো পছন্দ করে না।’ আরেক সেক্যুলার নারী জানান, ইসলামপন্থীরা তাকে হেয় করতে পারে- এই ভয়ে তিনিও সিটি সেন্টারে যেতে চাননি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কে সেক্যুলার জীবনধারাও অনেকাংশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। চলতি বছরের রমজান মাসে অ্যালকোহল সেবনের কারণে ইস্তাম্বুলের একটি ক্যাসেট বিক্রির দোকানে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে আহত করেছে ২০-২৫ জনের মতো লোক। এর প্রতিবাদে একদল লোক বিক্ষাভ প্রদর্শন করলে টিয়ার গ্যাস এবং জলকামন ব্যবহার করে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

১৯২৩ সালে তুরস্কে সেক্যুলার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কেমাল আতাতুর্ক। ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এরদোয়ান এবং তার দল একে পার্টি তার বিপরীত পথে হাটতে শুরু করেছে। একদিকে একে পার্টি দিন দিন তুরস্কে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে; অপরদিকে দেশটিকে সেক্যুলার মতবাদের পরিবর্তে শিক্ষা এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে ইসলামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এরদোয়ান নিজেও বলেছেন, তিনি তুরস্কে দীর্ঘদিনের সেক্যুলার শাসনের পরিবর্তে একটি ‘ধার্মিক প্রজন্মের উত্থান’ দেখাতে চান। ২০১১ সালে আরব ভূখণ্ডে শুরু হওয়া আরব বসন্তের সময় থেকে দেখা যায়, সিরিয়াতে সৌদি আরব এবং কাতারের সঙ্গে মিলে তিনি প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সুন্নিপন্থীদের সমর্থন দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি।

শুরুতে বাশার বিরোধী সব ধরনের যুদ্ধকে সমর্থন দিলেও ২০১৫ সালে এসে আইএস বিরোধী বিমান হামলায় যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যকে তুরস্কের ইনকিরলিক বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয় তুরস্ক সরকার। এর প্রতিশোধ নিতে জুনে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমান বন্দরে হামলা চালিয়ে ৪২ জনকে হত্যা করে আইএস। ইসলামি মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খুলে দিল ব্যর্থ এই অভ্যুত্থান।

অভ্যুত্থান সমর্থক হিসেবে পরিচিত হতে না চাইলে তার সব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে হবে তুর্কিদের। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার একটি উপায় খুঁজে পেলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। তুরস্কের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানান, গত বছর ৭ জুনের নির্বাচনের পর কুর্দিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায়ও ইতি টেনেছেন এরদোয়ান। আর এতে তার প্রতি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনও বেড়েছে।

অভ্যুত্থান চেষ্টা পরবর্তী সময়ে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে অবশ্য তুর্কি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। অনেকের ধারণা, এই সুযোগে বিরোধীদের দমন আরো সহজ হবে এরদোয়ানের পক্ষে। অভ্যুত্থানের জন্য ইতিমধ্যে তুরস্ক সরকার যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের দল গুলেন মুভমেন্টকে দায়ী করেছে। ফেতুল্লাহ গুলেন অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সূত্র : দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত