আল আজাদ

১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৫:১০

যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল সিলেট শহর

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। ঢাকায় বাঙালির ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল স্মারক তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী (এ এ কে নিয়াজী)। অস্ত্র জমা দিলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। এই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব করেন, মুক্তিবাহিনীর উপ সর্বাধিনায়ক এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার। এছাড়াও কয়েকজন অধিনায়ক উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় পুরো বাংলাদেশই ইতোমধ্যে পশ্চিমাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। তবে রাজধানীর মিরপুরসহ হাতেগোণা আরো কয়েকটি এলাকায় তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্মসমর্পণ করেনি। এরমধ্যে সিলেট শহরও ছিল। তবে ১৫ ডিসেম্বর থেকে প্রাণভয়ে ভীত পশ্চিমারা বলতে গেলে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল; কিন্তু অস্ত্র জমা দিচ্ছিলনা। কারণ ভরসা পাচ্ছিলনা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধরা দেওয়ার। তাই বারবার মিত্র বাহিনীর সন্ধান করছিল।

মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪ নম্বর সেক্টরের বারপুঞ্জি সাব সেক্টরের ৩ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে খাদিমনগর থেকে সিলেট সরকারি কলেজে (তখন নাম ছিল সরকারি এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) পৌঁছেন। অবস্থান নেন এমসি কলেজ (ঐ সময় নাম ছিল সরকারি কলেজ) ও সরকারি কলেজের মধ্যবর্তী খালে। এই কোম্পানিগুলোর অধিনায়কত্বে ছিলেন নৌ বাহিনীর সাব লেফটেন্যান্ট এম এ মতিন, ইফতেখার হোসেন শামীম ও সুবেদার মেজর দাইয়ান। অধিনায়কদের এ অবস্থানে থাকা অবস্থায়ই খাদিমনগর অবস্থান থেকে সাব সেক্টর অধিনায়ক মেজর আব্দুর রব ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, গোলাগুলি না করার জন্যে। তবে এতটুকুই। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান তুলে নিয়ে সরকারি কলেজ ভবনের আড়ালে চলে যান। অনুমান করা হচ্ছিল, সরকারি এমসি কলেজ বা এর আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকা পশ্চিমারা আক্রমণ চালাতে পারে।

অন্যদিকে মুক্ত এলাকা জৈন্তাপুর থানার (এখন উপজেলা) দরবস্তকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের কার্যক্রম শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল (১)-এর বেসামরিক উপদেষ্টা দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে। সরকারি দপ্তর স্থাপন করা হয় দরবস্ত সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে ৪ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) এবং মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টি এন সরকার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল কৃষ্ণ মেনন রাও, ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচী ও মেজর মুখার্জি সহ বিপুল সংখ্যক মিত্রসেনা ও মুক্তিসেনা অবস্থান করছিলেন।

সন্ধ্যার দিকে ইফতেখার হোসেন শামীম একটি খোলা জিপ নিয়ে যান খাদিমনগরে মেজর আব্দুর রবের সঙ্গে দেখা করতে; কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে চলে যান দরবস্ত। সেখানে পৌঁছতেই উল্ল­সিত সবাই হাসতে হাসতে তাকে জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। যে কথাটি শোনার জন্যে এত প্রতীক্ষা-এত ত্যাগ-এত কষ্ট তা শোনামাত্র উল্লাসে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু অনেক কষ্টে দমন করে রাখেন সেই ইচ্ছেটাকে। কারণ আনন্দটা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাইছিলেন। তাই কাজ দ্রুত সেরে রওয়ানা হন সিলেটের দিকে। পথ যেন ফুরোচ্ছিলনা।

যাই হোক, একসময় পৌঁছে যান রণাঙ্গনের সাথীদের কাছে। এসে খবরটি দিতেই আনন্দের বাধভাঙ্গা জোয়ার বইতে শুরু করে পুরো সরকারি কলেজ চত্বর জুড়ে। প্রাণের গভীর থেকে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে জয়ধ্বনি উঠে 'জয়বাংলা'। তবে সবাই ছিলেন সতর্ক, যাতে স্বপ্নপূরণের আনন্দে কারো কোন ভুল না হয়।

ইতোমধ্যে হাবিবনগর চা বাগান এলাকা থেকে দক্ষিণ সুরমার ঝালপাড়ার মনু মিয়ার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহকারী দল এসে পৌঁছ যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি আর দত্ত ও ৪ নম্বর সেক্টরের মেডিক্যাল অফিসার ডা নজরুল ইসলামও চলে আসেন। অত:পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিতে থাকেন শহরে ঢোকার; কিন্তু এর আগেই মিত্রবাহিনী সরকারি এমসি কলেজের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে শহরমুখী মুক্তিযোদ্ধাদের নিবৃত করে। কারণ রাস্তার মাইন পোঁতা থাকতে পারে। তাই মুক্তিবাহিনীকে ঠিক উল্টোপথে পাঠিয়ে দেওয়া হয় খাদিমনগরে। সেখানে একটি পুরনো ভবনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা খাদিমনগর থেকে এসে সিলেট শহরে ঢুকতে শুরু করেন। প্রথম লক্ষ্যস্থল সার্কিট হাউস। মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা ছাড়াও জেড ফোর্স প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেছেন বলে খবর জানা ছিল। সেখানে পেঁছেই মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা, কর্নেল সরফরাজ খান, ক্যাপ্টেন বসারত খান ও ক্যাপ্টেন ইফতেখার গণ্ডলসহ অন্যদেরকে গাড়ি বোঝাই করে সালুটিকর এলাকায় অবস্থিত তখনকার সিলেট মডেল স্কুলে (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজে) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোপূর্বে অন্যান্য কর্মকর্তাসহ পাকিস্তান বাহিনীর সাধারণ সেনাদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।

সকাল ১০টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় সবুজের মাঝে লাল সূর্যের বুকে সোনালী মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা। মুক্ত সিলেটে সাময়িকভাবে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ খানকে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় সেই সময়কার জামেয়া স্কুল (বর্তমানে ব্লু বার্ড স্কুল) ও মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে (বর্তমান জিয়া হোস্টেল)। অন্যদিকে মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা সার্কিট হাউসে, লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, মেজর শাফায়েত জামিল ও মেজর হাফিজ উদ্দিন উঠেন শারদা স্মৃতি ভবন সংসলগ্ন গণপূর্ত বিভাগের ভবনটিতে। আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি আর দত্ত ও মেজর আব্দুর রব ইফতেখার হোসেন শামীমের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।
 
একদিন পরে হলেও সিলেট শহর মুক্ত হবার মধ্য দিয়ে প্রায় পুরো সিলেট অঞ্চলই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়।

বি দ্র : লেখাটি যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমের (এখন প্রয়াত) স্মৃতিনির্ভর সেহেতু কোন ঘাটতি থাকলে বা কারো নিকট এ সংক্রান্ত আর কোন তথ্য থাকলে তা দিয়ে সহযোগিতা করার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

আল আজাদ : সভাপতি, সিলেট জেলা প্রেসক্লাব।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত