মোরসালিন মিজান

২৫ মার্চ, ২০১৫ ১৯:১৮

স্বাধীনতার ঘোষণা-বিকৃতির পূর্বাপর

‘ফ্রম টুডে বাংলাদেশ ইজ ইন্ডিপেনডেন্ট’ ইতিহাস বিকৃতির ইতিবৃত্ত

স্বাধীনতার ঘোষক ও ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল দালিলিক গ্রন্থেই রয়ে গেছে বিকৃতি। সরকারীভাবে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এই বিকৃতি স্পষ্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নতুন যোগ হওয়া কল্পকাহিনী উচ্চ আদালতের রায়ে দূর হলেও, বর্তমানে বহাল মূল তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ইতিহাস বিকৃতি।

কখনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। কখনও এটি অজ্ঞাতপ্রসূত। গ্রন্থ প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও, এ বিষয়টি নিয়ে যারপরনাই নির্বিকার। দীর্ঘ সময়েও বিভ্রান্তি দূর করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বিকৃত ইতিহাসের আলোকেই লেখা হচ্ছে নতুন নতুন ইতিহাস।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় গ্রন্থ রচনার মূল কাজ শেষে এরশাদ আমলে ১৯৮২ সালে এর তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতাযুদ্ধের এই দলিল প্রকাশ করে তথ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড নিয়ে এক রকম ছেলেখেলা করে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত তথ্য যথেচ্ছ বিকৃত করা হয়।

২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সংস্করণে নতুন করে যুক্ত করা হয়, ‘...মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’ এর প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২১ জুন সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ওই সংস্করণ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরিপন্থী, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় বাতিল ঘোষণা করেন। এর প্রকাশনা, মুদ্রণ, বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। পুনর্মুদ্রিত এই তৃতীয় খণ্ডটি বাজেয়াফত ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এর ফলে প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে মূল তৃতীয় খণ্ড বহাল থাকে।

অনেকেই মনে করেন, জোট সরকারের বিকৃত করা ইতিহাস হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল ও মূল তৃতীয় খণ্ড পুনর্বহাল হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাসংক্রান্ত ইতিহাসে আর কোন বিকৃতি নেই। এই দুটি দলিলের ভিত্তিতে এখন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতনভাবে পাঠ করলে ধরা পড়ে বিকৃতি। সংশ্লিষ্টদের অসততা, অজ্ঞতা, চাতুর্যের নানা উদাহরণ সামনে চলে আসে।

মূল তৃতীয় খণ্ডটি হাতে নিয়ে দেখা যায়, এর প্রথম পৃষ্ঠার দলিলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি হুবহু সংযুক্ত করা হয়েছে। এখানে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বলছেন- ‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent…’ দলিলটির সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা-‘বংগবন্ধু স্পীক্স।’ এ পর্যন্ত কোন ত্রুটি চোখে পড়ে না। কিন্তু দলিলটির শিরোনামে চোখ রাখতেই হোঁচট খেতে হয়।

একটি দুরভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিরোনামে স্বাধীনতার মহানায়ককে গৌণ করার সূক্ষ্ম চেষ্টা। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতার ঘোষণাটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, নেতাকে এখানে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকার করা হয় না। এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিরোনাম- ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা।’

এমন শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ঘোষণাটিকে আড়াল করার পাশাপাশি তাঁর ‘নামে স্বাধীনতা ঘোষণা’র বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এখানে ইঙ্গিত- শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তাঁর পক্ষে অন্য কেউ কাজটি করেছেন।

দলিলটির শিরোনামে দাবি করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোন সম্পর্ক নেই।

২৫ মার্চ মধ্যরাতেই ঘোষণাটি ওয়্যারলেসে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। রেডিও মনিটর করে বিশ্বের বহু পত্রিকা খবরটি প্রকাশ করে। পুরনো লাইব্রেরী ও কিছু দুর্লভ সংগ্রহশালায় বহুদিন খোঁজ করে ১৯৭১ সালের ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ মার্চ প্রকাশিত দেশী-বিদেশী পত্রিকার সন্ধান পেয়েছে এই প্রতিবেদক। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দি হিন্দুসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত এসব পত্রিকার খবরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সন্ধ্যায় প্রকাশিত হওয়ায় লন্ডনের ইভিনিং নিউজ ২৬ মার্চেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়। জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা পত্রিকার খবরে বলা রয়েছে, ‘Radio Pakistan announced that Sheikh Mujibur Rahman was arrested only hours after he proclaimed independence for East Pakistan...’

২৭ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি টাইমস লিখেছে- ‘Heavy Fighting as Sheikh Mujibur Declears E. Pakistan Independent...’ ২৭ মার্চ দি হিন্দু শিরোনাম করে ‘Mujib decleares E. Pak Independent.’ একই দিন কলকাতার AMRITA BAZAR PATRIKA পত্রিকা শিরোনাম করে ‘Mujib proclaims independence.’ শুধু পত্রিকায় নয়, ২৬ মার্চ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করেছে আমেরিকার হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুম। ডিআইএ (ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) রিপোর্টে বলা হয়, ‘Pakistan was thrust into civil war today when Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the east wing of the two-part country to be `the sovereing independent peopleÕs Republic of Bangladesh...’

এভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর আসে। কিন্তু এসবের কোনটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। মুজিবের নামে বা মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রমাণ করতে সূত্র করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে অথচ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ তাঁর সর্বজনগ্রাহ্য ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইতে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশ্যে আসার প্রায় ১৯ ঘণ্টা পরে ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে চালু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

ব্যাপক তথ্যানুন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, চালু হওয়ার পরও ওখান থেকে মুজিবের এই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়নি। ২৬ মার্চের বেতার অনুষ্ঠানের কোন রেকর্ড কারও কাছে নেই। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা’ শিরোনামে ছাপানো একটি হ্যান্ডবিল ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করা হয়। এ টি ডাঃ আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন বেলাল মোহাম্মদ। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে সেই হ্যান্ডবিলের একটি কপি প্রদর্শিত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত হ্যান্ডবিলটিতে বলা হয়েছে- ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করেছে... আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।’ হ্যান্ডবিলের নিচের অংশে আহ্বানকারী হিসেবে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এটি পাঠ করা হয়। নিজেদের নাম উল্লেখ না করে হ্যান্ডবিল পাঠ করেন বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও সুলতানুল আলম।

কারও কারও মতে, তারও আগে ২৬ মার্চ এমএ হান্নান ওই বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। দলিলপত্র ১৫ খণ্ডে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (দলিলপত্র গ্রন্থে যদিও সভাপতি উল্লেখ করা হয়েছে) লিখেছেন, ‘২৬ শে মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টার হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করি।’ এ কথার সহজ মানে, তিনিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেননি। তাঁর মতো করে বার্তাটি পরিবেশন করেছেন মাত্র।

একই খণ্ডের দ্বিতীয় দলিলটিও নানা বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। প্রথম দলিলে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা’ শিরোনাম করে ধোঁয়াশা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় দলিলে কথা খুব স্পষ্ট। শিরোনামে বলা হয়েছে- ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা।’ টেক্সটের একটি সূত্র ‘স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার টেপ রেকর্ড, ২৭ মার্চ, ১৯৭১।’ অথচ ওই দিনের কোন টেপ রেকর্ড কোথাও নেই। কখনও ছিল না।

সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, কালুরঘাট এলাকার বাসিন্দা ওসমান গনি ২৮ ও ২৯ মার্চের বেতার অনুষ্ঠান টেপ রেকর্ডারে বাণীবদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেলাল মোহাম্মদের সহকর্মী আমিনুর রহমানের মাধ্যমে সেটির ডাবিং সংগৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্র থেকে এর নির্বাচিত অংশ প্রচারিত হয়। এর একটি অবিকৃত কপি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং একজন ইতিহাসবিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। রেকর্ডগুলো চাইলেই শোনা যায়। কিন্তু ব্যাপক খোঁজখবর করেও ২৭ মার্চের কোন রেকর্ড কারও কাছে পাওয়া যায়নি। তাহলে দলিলের টেক্সটি কোথা থেকে এলো? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দলিলপত্রে যুক্ত করা টেক্সটি বানোয়াট। রেকর্ড না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মনগড়া টেক্সট সাজানো হয়েছে।

মেজর জিয়ার এই টেক্সটে বলা হয়েছে- ‘Major Zia, provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh.’ যে কোন সচেতন মানুষ এই টেক্সট পড়লে বিস্মিত হবেন। বইয়ে ব্যবহৃত টেক্সট অনুযায়ী, জিয়া কথা বলা শুরু করেন থার্ড পারসনে। ‘Major Zia’ বলে শুরু করেন তিনি অথচ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে এসে ফার্স্ট পারসন হয়ে যান। বলেন, ‘ও I also declare...’ এভাবে সচেতনভাবে পাঠ করলে ফাঁকিগুলো পরিষ্কার হতে থাকে। মেজর জিয়ার এই টেক্সট যে বানোয়াট তা বেলাল মোহাম্মদের বই পাঠে পরিষ্কার হয়ে যায়।

আলোচিত বইটিতে বেতারের সংগঠক লিখেছেন- ‘প্রথমে তিনি (মেজর জিয়া) লিখেছিলেন : I, Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh. আমি তখন বলেছিলাম : দেখুন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলবেন কী? তিনি (মেজর জিয়া) বলেছিলেন : হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। -নিজের নামের শেষে তীর-চিহ্ন দিয়ে লিখেছিলেন : on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman,…’ এতে প্রমাণ হয়, নানা পরিবর্তনের পাশাপাশি টেক্সট থেকে ‘আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু’ কথাগুলো বাদ দিয়ে মনগড়া ইতিহাস সাজানো হয়েছে।

দলিলপত্র গ্রন্থে এই টেক্সটের আরেকটি সূত্র ‘দি স্টেটসম্যান, দিল্লী, ২৭ মার্চ ১৯৭১।’ সূত্রটির বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরও বড় হোঁচট খেতে হতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লী থেকে প্রকাশিত দি স্টেটসম্যান এর দুর্লভ একটি কপি সংগ্রহ করে দেখা যায়, এর কোথাও মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার উল্লেখ নেই। দুই পৃষ্ঠার সংবাদ প্রতিবেদনে এমনকি তাঁর নামটি নেই অথচ আগের দিন ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিস্তারিত বিবরণ এতে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে- ‘PakistanÕs eastern wing, rechristened the independent state of Bangladesh by Sheikh Mujibur Rahman in a clandestine radio broadcast, was in the throes of a civil war on Friday with west wing troops...’ এর পরও ‘স্টেটসম্যান’ কে সূত্র করে অসততা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ গ্রন্থের সব দলিল অনুমোদন করেছে ৯ সদস্যবিশিষ্ট প্রামাণ্যকরণ কমিটি। কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, ‘গ্রন্থে আমরা শুধু দলিলগুলো যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। তবে প্রত্যেকটি শব্দ বাক্য দেখা সম্ভব ছিল না। সে ক্ষেত্রে ভুল থাকতে পারে।’ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটিকে ‘বঙ্গবন্ধুর নামে’ উল্লেখ করা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারের তথ্যটি ভুল বলে স্বীকার করেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক গ্রন্থে এত বড় বড় ভুল কী করে হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজে কোন ইন্টারফেয়ার করা হয়নি।’ তাহলে দায় প্রামাণ্যকরণ কমিটির? এমন জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, না। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বিষয়গুলো ভাল বলতে পারবেন। তবে জাতিকে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচাতে তৃতীয় খণ্ডের ভুল যতদ্রুত সম্ভব দূর করার আহ্বান জানান তিনি।

কমিটির আরেক সদস্য শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান। প্রথম দলিলটির বিকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে স্বাধীনতার ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে যায়নি। তাই ওখানে সূত্র হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।’ কিন্তু সব রকমের তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করা হয়নি। এর কোন টেপ রেকর্ডও নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে দলিলে এমন দাবি করা হলো? জানতে চাইলে তিনি ছোট করে জবাব দেন- ‘তখন ওগুলো চেক করেই দেয়া হয়েছিল।’ দ্বিতীয় দলিলের ক্ষেত্রে মিথ্যা সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে- এমন তথ্য জানানোর পর তিনি নিশ্চিত হতে চান, স্টেটসম্যানের সেই কপি প্রতিবেদকের সংগ্রহে আছে কিনা? নিশ্চিত হওয়ার পর বলেন, হ্যাঁ, সূত্রে ভুল থাকতে পারে।

এই দলিলের শিরোনামে মেজর জিয়াকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিরোনামে এভাবে বলা হলেও টেক্সটে তো ঠিক করে বলা হয়েছে। ওখানে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা আছে। ‘our great national leader Bangabandhu’ শব্দগুলো দলিল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমারও তো স্মরণ হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বলার আগে এই বিশেষণগুলো জিয়া ব্যবহার করেছিলেন।’ তাহলে দলিলে যুক্ত করা টেক্সটি বানোয়াট? এমন প্রশ্নে সরাসরি উত্তর না দিলেও আনিসুজ্জামান অনেক বড় একটি সত্য জানিয়ে বলেন, পুরো কাজটি জিয়ার শাসনামলে হয়েছে। সময়টি অনুধাবন করতে হবে। তার মানে, আপনাদের সীমাবদ্ধতা ছিল? স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে তখন সাহসের প্রয়োজন ছিল। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। তবে আমরা কখন কী ধরনের কাজ করতাম তার সবই ইন্টেলিজেন্সের লোকরা জানত। সব সময় খোঁজ রাখত। অনেক সময় ওঁরা এসে আমাদের কাগজপত্র নিয়ে যেত। পরে আবার ফেরত দিয়ে যেত।

স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষক প্রশ্নে যত বিভ্রান্তি সব দূর করার লক্ষ্যে বিষয়টির ওপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ইতিহাসকে নির্মমভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে। এটি দালিলিক গ্রন্থ অথচ প্রচুর ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে তা দেখে ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি মারাত্মক ব্যথিত হই। লজ্জায় পড়ে যাই।

তিনি বলেন, প্রথম দলিলটির শিরোনাম হওয়া উচিত ‘শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা।’ দ্বিতীয় দলিলটির প্রকৃত শিরোনাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা।’ টেক্সটির শিরোনাম করা হয়েছে ‘DECLARATION OF INDEPENDENCE.’ এই শিরোনামও জিয়ার বেলায় প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে শিরোনাম হবে- DECLARATION OF INDEPENDENCE ON BEHALF OF SHEIKH MUJIBUR RAHMAN. এসব ত্রুটি দূর করা ও প্রকৃত ইতিহাস লেখার তাগিদ বহুদিন ধরে দিয়ে আসছেন জানিয়ে এই গবেষক বলেন, সংশ্লিষ্টরা মনে করেন দলিলে ভুল আছে স্বীকার করলে তাঁরা ছোট হয়ে যাবেন। ফলে এ নিয়ে চুপ থাকা এখন নিয়ম হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিনেও বিকৃতি দূর করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সেই সুযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে নতুন নতুন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। এবার অন্তত সরকারের উচিত দলিলের বিকৃতি দূর করে আগামী প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাসটি তুলে ধরা।

মোরসালিন মিজান: সাংবাদিক
লেখাটি ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক জনকন্ঠে প্রথম প্রকাশ হয়।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত