কবির য়াহমদ

১১ এপ্রিল, ২০১৫ ২২:১২

যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর: হেসে ওঠল সোহাগপুর, হেসে ওঠল বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ্বিতীয় অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

দীর্ঘ পৌণে পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া, ৪৪ বছরের অপেক্ষা আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, চাপ উপেক্ষা করে অবশেষে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে প্রায়শ্চিত্ত করল একাত্তরের ঘাতক, গণহত্যার পরিষ্কার অংশীদার, আল বদর কমান্ডার মোহাম্মদ কামারুজ্জামান।

কামারুজ্জামানের ফাঁসির মাধ্যমে হেসে ওঠল সোহাগপুরের বিধবাপল্লী, হেসে ওঠল বাংলাদেশ। কলঙ্কমুক্তির পথে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলো আর এক ধাপ!

শনিবার ( ১১ এপ্রিল) রাত ১০ টা ১ মিনিটে তাকে ফাঁসির কাষ্ঠের ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। 

৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর সর্বশেষ উপায় রাষ্ট্রপতির কাছে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন এ যুদ্ধাপরাধী। অবশেষে ১০এপ্রিল কামারুজ্জামান জানান তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না তখন থেকেই মূলত ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি থেকে যায় সময়ের অপেক্ষায়।

অবশেষে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ! ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে একাত্তরের গণহত্যাকারি কামারুজ্জামান তার অপরাধের প্রকৃত শাস্তি পেলো।

মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি আর চাপের সম্মুখিন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র জোটসঙ্গী হওয়ার কারণে রাজনৈতিকভাবে তাদের শক্তিমত্তাকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। তার ওপর দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিকভাবে তারা ছিল শক্তিশালীও।

এ অর্থবিত্ত দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করতে তারা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, যারা প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করে এ বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছিল। শেষ মুহুর্তে হিউম্যান রাইটস ওয়্যাচ, ইইউ ও জাতিসংঘের ফাঁসি স্থগিতের আবদারকে পাত্তা দেয়নি বাংলাদেশ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এই অঙ্গীকার ঘোষণার মাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতাসীন হন। এরপর গঠিত হয় ট্রাইব্যুনাল, একে একে যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের সম্মুখিন হয়।

সবেচেয় লক্ষ্যণীয় বিষয়, শত বাঁধা-বিপত্তির মুখে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনই তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার থেকে সরে আসেননি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ ও প্রতিষ্ঠান যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছিল সেখানে শেখ হাসিনা ছিলেন তাঁর অঙ্গীকারের প্রতি অটল, অবিচল।

যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে বিচার প্রক্রিয়ার সবক’টি আদালতে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় ফাঁসির কার্যকর হিসেবে তিনিও আরেক আল বদর কমান্ডার আবদুল কাদের মোল্লার সঙ্গী হলেন। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয় ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের দৃষ্টান্ত।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম:
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান পিপিএম কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন।

তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন প্রসিকিউশন। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় আমলে নেওয়ার পরিবর্তে ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।

ওই বছরের ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন।

২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।

২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম মুক্তা। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।

তাদের মধ্যে ১৫ জন ঘটনার সাক্ষী হচ্ছেন, ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক, শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন, বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মো. হাসানুজ্জামান, লিয়াকত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পুত্র জিয়াউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান মো. জালাল উদ্দিন, শেরপুর জেলার ‘বিধবাপল্লী’নামে খ্যাত সোহাগপুর গ্রামের নির্যাতিত (ভিকটিম) তিন নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), মুজিবুর রহমান খান পান্নু এবং দবির হোসেন ভূঁইয়া।

আর জব্দ তালিকার প্রথম সাক্ষী হলেন বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমেনা খাতুন। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।

অন্যদিকে কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০১৩ সালের ৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তারা হচ্ছেন মোঃ আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম। তাদের জেরা সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।

এর আগে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী। বিপক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম। ৭ জানুয়ারি এ আবেদন খারিজ করে দেন  ট্রাইব্যুনাল।


ওই বছরের ১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।

২০১৩ সালের ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এবং ১৬ এপ্রিল ৫ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা।

অন্যদিকে ৩ থেকে ১৬ এপ্রিল ৪ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী।

২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে এবং বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ২১৫ পৃষ্ঠার রায়টি ঘোষণা করেন।

আপিল মামলার কার্যক্রম:
ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৬ জুন আপিল বিভাগে আপিল করেন কামারুজ্জামান। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় কামারুজ্জামানের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

১২৪টি যুক্তিতে আপিল করেন আসামিপক্ষ। তাদের মূল আবেদন ১০৫ পৃষ্ঠার। আর এর সঙ্গে দুই হাজার পাঁচশ’ ৬৪ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আপিলের সার-সংক্ষেপ জমা দেন আসামিপক্ষ।

সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নিজে এ আপিল মামলার শুনানিতে না থেকে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের পৃথক আপিল বেঞ্চ গঠন করে দেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

এ বেঞ্চে গত বছরের ৫ জুন থেকে আপিল শুনানি শুরু হয়। ওই দিন থেকে মোট ১৭ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয়। এর মধ্যে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ও ১৭ সেপ্টেম্বর ১৫ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে ৪ কার্যদিবস শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

আপিল শুনানি শেষ হওয়ায় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল মামলাটির রায় অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ কামারুজ্জামানের এ ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওইদিন দুপুরে চার বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর দেওয়া শেষ করলে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়।

লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা:
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতেই আপিল বিভাগ থেকে ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পৌঁছে দেওয়া হয় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একই সঙ্গে পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালের রায় ও অন্যান্য ডকুমেন্টস, যেগুলো আপিল শুনানির জন্য পাঠানো হয়েছিল আপিল বিভাগে।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান পূর্ণাঙ্গ রায় গ্রহণ করে মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া শুরু করেন।

পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ট্রাইব্যুনাল-২ এর ৩ বিচারপতি মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন।

এর পর লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যু পরোয়ানার সঙ্গে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

কারাগারে পৌঁছানোর পর কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। তিনি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কপিটি আইজিপি (প্রিজন) এর বরাবরে পাঠানো হয়। এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয় মৃত্যু পরোয়ানার অনুলিপি।

রিভিউ মামলার কার্যক্রম:
আইন অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় পান আসামিপক্ষ। সে অনুসারে গত ৫ মার্চ ২০১৫ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ মার্চ চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চান আসামিপক্ষ।

আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে দু’দফায় পিছিয়েছে শুনানির দিন। গত ৯ মার্চ শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এলে প্রথমবার চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানান আসামিপক্ষ। এর কারণ হিসেবে খন্দকার মাহবুব হোসেনের ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা বলা হয়েছিল। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি পিছিয়ে গত ১ এপ্রিল পুনর্নির্ধারণ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

১ এপ্রিল কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন অসুস্থ বলে উল্লেখ করে ফের চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানানো হয়। ওইদিন চারদিন পিছিয়ে রোববার (৫ এপ্রিল) দিন পুনর্নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ।

অবশেষে রোববার সকালে শুনানি শেষ হলে সোমবার (৬ এপ্রিল) রায়ের দিন ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত। আসামিপক্ষে কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। সোমবারের রায়ে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়ায় কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় চূড়ান্তভাবে বহাল থাকে।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) চূড়ান্ত এ রায়ের খসড়া লেখা শেষ করেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। বুধবার (৭ এপ্রিল) দুপুর নাগাদ চার বিচারপতি মিলে সেটি চূড়ান্ত করে ৩৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর সেটি যায় ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেরারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুন বিচার শুরু হয়েছিল।

প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। একাত্তরের ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন।

এ বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহে (ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল) গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত করে।

তার বিরুদ্ধে আনা সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ হলো :

প্রথম অভিযোগ :
এতে বলা হয়েছে, ৭১’র ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারারাত নির্যাতন করা হয়। পরদিন আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ :
কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে মাথা ন্যাড়া করে উলঙ্গ অবস্থায় গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায়।

তৃতীয় অভিযোগ :
৭১’র ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। এ সময় ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।

চতুর্থ অভিযোগ :
৭১’র ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যায় আবুল কাশেম।

পঞ্চম অভিযোগ :
মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দু’জনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ ৮ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ষষ্ঠ অভিযোগ :
৭১’র নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।

সপ্তম ও শেষ অভিযোগ:
মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান দিন দুপুরে কামারুজ্জামান আল-বদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আল-বদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে আরও বলা হয়েছিল, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১, ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ আনা হয়েছিল।

তথ্যসূত্র: বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, অনলাইন নিউজপোর্টাল, আইসিটি সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত