সিলেটটুডে ডেস্ক

২৯ জুলাই, ২০১৫ ০০:১২

ট্রাইব্যুনালে সাকার যত ঔদ্ধত্য : ‘দুই বছর জেলে রাখছস, বাইর হইয়া নেই’

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরীর আপিলের রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকার এক নম্বরে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে গ্রেফতার করা হয় সাকা চৌধুরীকে। গ্রেফতারের আগে ও বিভিন্ন সময় নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন। এমন কি হাজতবাসের সময়ও তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকে পর্যন্ত হুমকি দিয়েছেন, স্বয়ং ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়েই। শুধু সাকা চৌধুরী নন, তার আইনজীবী ও স্বজনেরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে কথা বলেছেন, বাজে মন্তব্য করেছেন।

বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘চোখ রাঙাবেন না’।
২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুনানি চলাকালে এজলাসকক্ষেই প্রকাশ্যে এ হুমকি দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে। সাকা চৌধুরী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, দুই বছর জেলে রাখছস, বাইর হইয়া নেই...

আবার ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে সাকা চৌধুরী বলেন, আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। অনেক আইন আমি করেছি। এ আইনও (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন’১৯৭৩) আমার করা। আপনি তো আমার করা এ আইন পড়েও দেখেননি।

২০১৩ সালের ১৭ জুন নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সময় পুরো ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করেই বলে ওঠেন, ‘আমাকে ফাঁসি তো আপনারা দেবেনই, কিন্তু আমি পরোয়া করি না। ওইদিন এমনকি সাক্ষ্য দেওয়া শুরুর আগে আইন অনুসারে শপথ নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমি একজন সংসদ সদস্য। আমি কেন এখানে শপথ নেব?’ পরে শপথ ছাড়াই সাক্ষ্য দিতে শুরু করেন সাকা চৌধুরী।

সাক্ষ্যের এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম। তাই এদেশের সংবিধান রক্ষা করাও আপনাদের কর্তব্য। আপনারা সংবিধান রক্ষা করেই বিচার করবেন।’
বিভিন্ন সময়ে প্রসিকিউটরদের হেয় করে ‘পার্সিকিউটর’ বলেছেন তিনি। একবার অাদালতে বলেছেন, গত আড়াই বছর ধরে আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে তাতে কি ‘পার্সিকিউটর’ বলব না তো কি হাজি সাহেব বলব?

২০১৩ সালের ২ জুলাই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের একদিন ফাঁসিতে ঝুলতে হতে পারে বলে পরোক্ষ ভয় দেখান সে সময়কার সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরী। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড় করিয়েছেন আর আমি কথা বলতে পারব না? ভবিষ্যতে আপনাদেরও এখানে দাঁড়াতে হতে পারে।’

সেদিন নিজের পক্ষে শেষ দিনের সাফাই সাক্ষ্য দানকালে জেয়াদ আল মালুমকে এ হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে বাদানুবাদে জড়ান তিনি।

এসময় সাফাই সাক্ষ্যের পুরোটাই ইংরেজিতে দেন সাকা চৌধুরী। এর সপক্ষে নিজেকে বাঙালি নয়, চাটগাঁইয়া বলে দাবি করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আপনি বাংলায় সাক্ষ্য দিলে এতো সময় লাগতো না। তার চেয়েও বেশি কথা বলতে পারতেন।’
জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি বাংলায় সাক্ষ্য দিতে পারব না, ইংরেজিতেই দেব। কারণ, আমি বাঙালি না চাটগাঁইয়া। বাংলায় তো আমি ভালো বলতে পারতাম না। টেকনিক্যাল প্রবলেম হতো। এক সময় ভাষার প্রতি চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলে ওঠেন, আমার মাতৃভাষা বাংলা নয়, চাটগাঁইয়া ‘

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার সাক্ষ্যে এ দাবিও করে বসেন, তিনি পছন্দসূত্রে বাংলাদেশি, জন্মগতভাবে নন।

ট্রাইব্যুনালের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে-বসে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও বাক্যবাণ ছুড়ে এজলাসকক্ষের পরিবেশও বেশ কয়েকবার উত্তপ্ত করে তোলেন সাকা চৌধুরী। স্বভাবসুলভভাবে সব সময়ই বিচারকাজ চলাকালে গোঁয়ার্তুমিও করে গেছেন। অনেক সময় বিচার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় তাকে ছাড়াও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তারপরও তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেই গেছেন। ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে অসংখ্য দিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আপনি সহযোগিতা করছেন না। আপনি অসংলগ্ন আচরণ করছেন।’ একবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিৎকার করে কথা বলে শুনানির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় সাকা চৌধুরীকে মধ্যাহ্ন বিরতির পর এজলাস কক্ষে আনতে নিষেধও করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

বিভিন্ন সময়ে সাকা চৌধুরী তার উদ্ধত আচরণ এবং অশালীন কথার জন্য সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। আবার এজলাস কক্ষে হাসির খোরাকও জুগিয়েছেন। কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েও। বলেছেন, গোপালগঞ্জের মেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি আমার জন্য এই অ্যাক্ট (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন ১৯৭৩) সংশোধন করেছেন।

রাজনীতির মাঠে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার গোঁয়ার্তুমির কারণে বরাবরই সমালোচিত নাম। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে চূড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি হয়েও তার স্বভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

ট্রাইব্যুনালও তাকে বলেছেন, আমরা আপনাকে সুযোগ দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক বেশি কথা বলার অভ্যাস আপনার রয়েছে। কারণ, আপনি অনেক বেশি জানেন, দয়া করে উত্তেজিত হবেন না।

বুধবার সাকা চৌধুরীর আপিল মামলা রায় ঘোষণার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এসেছে। ২৯ জুলাই বুধবার এর কার্যতালিকায় রায়টি এক নম্বরে রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করবেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

সাকা চৌধুরীর রায়ের ব্যাপারে আদালতে কোনো চাপ নেই বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেলের মাহবুবে আলম। এ সময় তিনি সালাহউদ্দিন কদেরের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

এর আগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেননি সেগুলো থেকেও সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে চারটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকা চৌধুরীকে। তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দু’টি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। সব মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৭০ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি।

যে চারটি হত্যা-গণহত্যার দায়ে সাকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো ৩ নম্বর (অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা), ৫ নম্বর (রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা), ৬ নম্বর (রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা) এবং ৮ নম্বর (চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যা) অভিযোগে।

অন্যদিকে ২ নম্বর (রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা), ৪ নম্বর (জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যা) এবং ৭ নম্বর অভিযোগে (রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা) আনা তিন হত্যা-গণহত্যায় সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

১৭ এবং ১৮ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে আরও পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যে দু’টি অভিযোগে যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন এবং চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত