রাইআন কাব্য

১৯ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:০৮

সাকা’র পক্ষে মাহবুবের সার্টিফিকেট জালিয়াতি : প্রতিদান কেবলই ‘তিরস্কার’!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য শুরু থেকে নানা অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, তার পরিবার ও তাদের আইনজীবি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন।

বুধবার (১৮ নভেম্বর) বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষ দিনেও সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করেন তিনি। ভুয়া কাগজপত্র দাখিলের অভিযোগে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তিরস্কৃত হন খন্দকার মাহবুব হোসেন

এদিকে, জাল সার্টিফিকেট দিয়ে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টার জন্যে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন খন্দকার মাহবুব। বিচারিক পর্যায়ের সর্বশেষ ধাপে এসে এভাবে পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করার পরেও কোন ধরনের শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলনের সংগঠক শামস রাশীদ জয় খন্দকার মাহবুবের প্রতারণার জন্যে তার সনদ বাতিলের দাবি জানিয়ে ফেসবুকে লিখেন, 'আশা করি ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করার অপরাধে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক কঠিন সাজা দেয়া হবে।'

জয়ের একই স্ট্যাটাসে বাবু খোকন নামের একজন মন্তব্যে লিখেন, 'এই লোকের আইন ব্যাবসা বন্ধ করা দরকার।'

এদিকে, আদালতে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে রায় প্রভাবিত করার অপচেষ্টার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন এই জালিয়াতির শাস্তি কেবলই মৃদু তিরস্কার। এ ধরনের অপরাধের টুটি চেপে না ধরলে ভবিষ্যতে আরও অনেক অপরাধী এ ধরনের জালিয়াতিতে উৎসাহ পাবে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।

বুধবার রিভিউ আবেদনের শুনানিকালে সাকা চৌধুরীর পক্ষে আইনজীবি খন্দকার মাহবুব আদালতে পাকিস্তানি ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করলে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা খন্দকার মাহবুবের উদ্দেশে বলেন, এগুলো ফেক (ভুয়া)। আপনারা একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে অনেকগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

‘‘আপনারা পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে সাকার সার্টিফিকেট এনে দিয়েছেন। অথচ এগুলো ফেক (ভুয়া)। আপনারা একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে অনেকগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।’’

তখন খন্দকার মাহবুব প্রধান বিচারপতিকে বলেন, ‘এ সার্টিফিকেটের বিষয়ে সন্দেহ হলে আপনারা দূতাবাস ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যমে তা যাচাই করে দেখতে পারেন।’

প্রধান বিচারপতি তখন হাসতে হাসতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘মিস্টার অ্যাটর্নি জেনারেল শোনেছেন? আপনাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে সার্টিফিকেটগুলো যাচাই করতে বলছেন খন্দকার মাহবুব।’

খন্দকার মাহবুব আরও বলেন, ‘পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সালাউদ্দিন কাদেরকে প্রত্যায়নপত্র দিয়েছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডিট ট্রান্সফার করেছিলেন।’

এর জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মাই লর্ড, আমিও ওই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম। তখন ক্রেডিট ট্রান্সফার কিংবা সেমিস্টারের সিস্টেম ছিল না।’


মাহবুবে আলম বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া যে ডুপলিকেট সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করেছেন সেটা ২০১২ সালে ইস্যু করা। আদালত তা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। ২০১৩ সালে তিনি যখন সাক্ষ্য দেন তখন এটা উল্লেখ করেননি।

তিনি বলেন, পাকিস্তানে আমাদের যিনি হাইকমিশনার আছেন তিনি সেখানে কোনো সত্যায়িতও করেননি। কাউন্টার সাইন করতে হয়, সেটা করা হয়নি। আইনের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি কীভাবে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিলেন সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। জানান মাহবুবে আলম।

"সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পাকিস্তানে অবস্থানের বিষয়ে ২০১৩ সালের জুলাইতে নিজেই আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এসব কিছু উল্লেখ করেননি। সুতরাং এই সার্টিফিকেট শেষ মুহূর্তে বিবেচনায় আনার প্রয়োজন আছে বলে আদালত মনে করেনি। আমরাও একই রকম বক্তব্য দিয়েছি।

“তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কোনো বিদেশি কাগজ সেই দেশের নোটারি পাবলিকেশন্সের সামনে অথেনটিকেট করতে হয়। ওটা সাইন করেন সেখানে আমাদের দেশের অ্যাম্বাসেডর, হাইকমিশনার অথবা অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

"পাকিস্তানে আমাদের হাইকমিশনার সেখানে স্বাক্ষর করেননি। সুতরাং এটাকে কাউন্টার সাইন করার প্রশ্ন আসে না। আইনি প্রক্রিয়ায় এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

"আজকের কথিত সার্টিফিকেটে লেখা ছিল সেশন- ১৯৭১, এর আগে একজন কথিত অধ্যাপকের একটি সার্টিফিকেইট দেওয়া হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল সেশন ১৯৭০-৭১। সেশন কখনও এক বছর হয় না। হয়তো ৭০-৭১ হবে, অথবা ৬৯-৭০ এরকম হবে।

"যেহেতু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভর্তি দেখানো হয়েছে ১৯৬৮ সনে, তারা মৌখিকভাবে বলেছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্রেডিট টান্সফার করা হয়েছে।

"ওই সময় আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে পড়তাম। সেই সময় আমাদের কোনো সেমিস্টার সিস্টেম ছিলনা। সুতরাং ক্রেডিট ট্রান্সফারের কোনো বিধানও তখন ছিল না। সেমিস্টার সিস্টেম চালুর পর আমাদের দেশে ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিষয়টি চালু হয়।

"সুতরাং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এতো শর্ট টাইমে পাস করার বিষয়টিও নিয়ম বহির্ভূত।"

প্রধান বিচারপতি তখন খন্দকার মাহবুবকে বলেন, ‘ফেক সার্টিফিকেটগুলো আপনারা কেন আমাকে দিলেন? লন্ডন, ওয়াশিংটনের সার্টিফিকেট দিলেন কিন্তু পাঞ্জাবেরটা দিতে পারলেন না কেন?’

উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘সনদ’ ও ‘প্রশংসাপত্র’ জমা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে সাকা চৌধুরী যে পাকিস্তানের লাহোরে ছিলেন, তা প্রমাণ করতেই ওই নথি দেওয়া হয়েছিল।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সত্যায়িত করা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সনদ’-এর প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সার্টিফিকেটে ১৯ সংখ্যাটি বড় আর ৭১ সংখ্যাটি ছোট। ট্রাইব্যুনালে এর আগে দেওয়া ডকুমেন্টের সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই। একটা মিথ্যা ধামাচাপা দিতে শতটা মিথ্যা কথা বলছেন তিনি।’

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘যখন এই বিচার শুরু হলো, তখন পাকিস্তান এই বিচারের বিরোধিতা করেছে। তারা এই বিচারের বিরুদ্ধে রেজল্যুশন (প্রস্তাব) পাস করেছে। সেখান থেকে যেসব নথি আসছে, প্রতিটিতে আমাদের সিরিয়াস ডাউট (গুরুতর সন্দেহ) আছে।’

একপর্যায়ে খন্দকার মাহবুবের কাছে প্রধান বিচারপতি চারটি প্রশ্ন তোলেন। প্রথমত, ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগে নথিগুলো জাল প্রমাণিত হওয়ার পরও নতুন করে কেন নথি দেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয়ত, লন্ডন-ওয়াশিংটন থেকে হলফনামা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পাঞ্জাব থেকে দেওয়া হয়নি কেন? তৃতীয়ত, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন? চতুর্থত, ২০১২ সালের নথি এখন কেন দিচ্ছেন?

জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আপনাদের ডাউট হলে আমাদের বেনিফিট হবে। আপনারা তদন্ত করেন। রায় দিতে গেলে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে রায় দিতে হবে।’

সাকা চৌধুরীর পক্ষ থেকে যে ‘সনদ ও প্রশংসাপত্র’ দেওয়া হয়েছে, তাতে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ধরনের লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ওই ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেটে সেশন লেখা ১৯৭১, তবে প্রশংসাপত্রে সেশন ১৯৭০-৭১। সনদে ১৯৭১ লেখার মধ্যে ১৯ সংখ্যাটি অনেক বড়, ৭১ সংখ্যাটি খুব ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেও পার্থক্য রয়েছে।

সনদে লেখা ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব দ্য পাঞ্জাব’, প্রশংসাপত্রে লেখা ‘ইউনিভার্সিটি অব দ্য পাঞ্জাব’। আবার সনদ ও প্রশংসাপত্রে পাঞ্জাব বানান দুই ধরনের। এমনকি খোদ সাকা চৌধুরীর নামের বানান দুটিতে দুই ধরনের। সনদে নামের বানানে ‘এইচ’ থাকলেও প্রশংসাপত্রে ‘এইচ’ নেই।

এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালান সাকা চৌধুরী। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর তাঁর ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই রায় ঘোষণার আগে রায়ের খসড়া ফাঁস করে আসামি সাকা চৌধুরীর স্ত্রী, ছেলে ও আইনজীবী , সেটা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে একটি মামলাও চলমান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত