নিউজ ডেস্ক

১৮ মার্চ, ২০১৬ ০৯:০১

মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে ‘রাজাকারপুত্র’ আ.লীগের প্রার্থী!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন চিহ্নিত এক রাজাকারের ছেলে।

দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক একক সিদ্ধান্তে ‘রাজাকার’ তাজুল ইসলামের ছেলে ফারুক মিয়াকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন।

এনিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদাতা দলের প্রার্থী হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধী একজনের সন্তানকে মেনে না নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দলের হরিপুর ইউনিয়নের নেতারা প্রার্থী বদলের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিতে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার জানিয়েছেন।

হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. দৌলত রেজা বলেন, “ফারুকের বাবা তাজুল ইসলাম ওরফে তাইজুদ্দিন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে তাজুল ইসলাম নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল।

“অথচ মন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই চিহ্নিত এ রাজাকারের ছেলেকে দলের মনোনয়ন দিয়েছেন। আমরা মন্ত্রীর দেওয়া এই মনোনয়নের বিরোধিতা করছি। কোনো রাজাকারের ছেলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারে না।”

হরিপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জামাল উদ্দিন বলেন, একাত্তরে চান্দুরার সাতগাঁওয়ের রাজাকার কমান্ডার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে তাজুল হরিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক বাড়িতে লুটপাট করেছে।

“হেন কাজ নেই যা একাত্তরে তারা করেনি,” বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি বলেন, একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর নাসিরনগর মুক্ত হওয়ার পর ১৪ ডিসেম্বর হরিপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন তাজুলসহ পাঁচজন। এরপর হরিপুর শ্মশানে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হারুন অর রশীদ এই ঘটনার সত্যতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, “আরেক রাজাকার আনজব আলী এখনও জীবিত আছে। সে তাইজুদ্দিনের ভাই।”

“আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কোনোভাবেই চাই না যে মানুষ একাত্তর সালে মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার সন্তান আওয়ামী লীগের টিকেট নিয়ে নির্বাচন করুক,” বলেন মুক্তিযোদ্ধা হারুন।

আগামী ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ফারুক দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। এতদিন আমাকে কেউ রাজাকারের ছেলে বলেনি।

“এখন নির্বাচনে আসায় প্রতিপক্ষের লোকজন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজাকারের ছেলে বলে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছে। দেখবেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে এ অভিযোগ আর থাকবে না।”

রাজাকারের ছেলে সম্পাদক পদে

নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের চিহ্নিত রাজাকার অন্তর আলীর ছেলে আমিনুল ইসলাম বেলায়েত দলের ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক আলী আব্বাস বলেন, “পাঠানিসার গ্রামের রায়ের বাড়ি এবং জেঠাগ্রামের কুঞ্জ মোহনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে অন্তর আলী রাজাকারের বিরুদ্ধে।”

সাবেক ইউপি সদস্য নুরপুর গ্রামের এম এ কাশেম বলেন, “একাত্তরে আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন গ্রামের রাজাকারদের সহায়তায় একদল পাকসেনা আমাদের বাড়ি এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।

“তারা আমাকে নুরপুর গুরুপদ রায়ের বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে আরও ৩০/৩৫ জন নিরীহ লোককে জড়ো করা হয়। সেদিন পাক সেনারা আমাদের দিয়ে গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। পরে জানতে পারি অন্তর আলী রাজাকার তাদের দলে ছিল।”

তবে বেলায়েত দাবি করেছেন, তার বাবা রাজাকার ছিলেন না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে এখন এই প্রচার চালানো হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য

স্বাধীনতাবিরোধীদের দলে না ভেড়াতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশের মধ্যেই এই ঘটনায় নাসিরনগরের আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তারা বিষয়টি জানতেন না।

ফারুক মিয়ার মনোনয়ন বাতিল এবং বেলায়েতকে অপসারণের দাবি জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মানববন্ধন ও সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার বলেন, “আমাদের কেউ বিষয়টি লিখিতভাবে জানায়নি। তাই তারা আওয়ামী লীগের পদে আছেন।”

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ইউপি নির্বাচনে ফারুককে প্রার্থী করার জন্য দায়ী করেছেন মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ছায়েদুল হককে। বেলায়েতকে নেতা করার দায় উপজেলা আওয়ামী লীগকে দিয়েছেন তিনি।

মামুন বলেন,“মন্ত্রী ছায়েদুল হক একাই নাসিরনগর ডাক বাংলোয় বসে হরিপুর ইউনিয়নে ফারুককে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। যেভাবে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন তা অবৈধ।”

তিনি বলেন, দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ৃরাজাকারপুত্রকে মনোনয়ন দেওয়া যায় না। এছাড়া মন্ত্রীর একার মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ারও নেই।

তাই হরিপুরসহ পাঁচটি ইউনিয়নে জেলা আওয়ামী লীগ নতুন করে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে বলে জানান তিনি। মন্ত্রীর দেওয়া মনোনয়ন বাতিল করতে কেন্দ্রে চিঠিও পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান। বিডিনিউজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত