নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ জুন, ২০১৬ ১১:৩৪

‘ভয়াল’ মাগুরছড়া দিবস আজ, ১৯ বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ

ছবি: সংগ্রহ

১৪ জুন মাগুরছাড়া দিবস। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের মধ্যবর্তী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকার মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ খননকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পুড়ে যায় বনাঞ্চল, রেল লাইন, সড়কপথ, ঘর-বাড়ি, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকা।

মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া গ্যাস ট্রাজেডির ১৯ বছর কেটে গেলেও আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ। এ কারণে এখনো ক্ষোভের আগুনে পুড়ছেন স্থানীয় বনজীবি ও আদিবাসীরা।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের সংরক্ষিত বনাঞ্চল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খননের কাজ করেছিল৷

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে খননকাজ গ্যাসকূপের ৮৫০ ফুট গভীরে পৌঁছালে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে৷ এতে প্রায় পাঁচ শ ফুট উচ্চতায় আগুন লাফিয়ে ওঠে।

 ছবি: সংগ্রহ

আগুনে উদ্যানের গাছপালা, মাগুরছড়া পানপুঞ্জি, ফুলবাড়ী চা-বাগানের একাংশ, ঢাকা-সিলেট রেললাইন, ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল সড়কপথ, বিদ্যুৎ লাইনসহ আশপাশের এলাকা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সেগুন প্রজাতির গাছ, বাঁশ, অন্যান্য প্রজাতির বৃক্ষ, বৃক্ষলতাদিতে আচ্ছাদিত ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারাত্মক, আংশিক ও হালকাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ ছিল ৮৭ দশমিক ৫০ একর৷

দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পশুপাখি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক শোষণব্যবস্থা, প্রাকৃতিক উৎপাদন, পশুপাখির বসতি, ভূপৃষ্ঠস্থ প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের অধোগমন ও প্রাণিবৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে।

ছবি: সংগ্রহ

ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ছোট-বড় ৩৯টি চা বাগানের ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ, ২ হাজার ফুট রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস বাবদ ক্ষতি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫, সড়কপথ বাবদ ২১ কোটি, গ্যাস পাইপলাইন বাবদ ১৩ লাখ, বিদ্যুত লাইন বাবদ ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬, খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজ বাবদ ধরা হয়েছে ১৮ লাখ, বাসমালিকদের রাজস্ব ক্ষতি ধরা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। আর বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূগর্ভের গ্যাসের পরিমাণ ৪৮৫.৮৬ বিসিএফ এবং এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৪৫.৮৬ বিসিএফ ধরা হয়। উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৪ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা।

ছবি: সংগ্রহ

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির এতগুলো বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ওই মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে আজও মেলেনি ক্ষতিপূরণ। 

বন ও পরিবেশ বিভাগ সূত্রেও জানা গেছে, বনাঞ্চল ও পরিবেশের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি।

কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের আগে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মাটিতে বিচরণকারী কচ্ছপ ও প্রচুর জংলি খরগোশ দেখা যেত। এখন চোখে পড়ে না। ছড়ার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক জলজ প্রাণীরও দেখা মেলে না।

মাগুরছড়া পানপুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) জিডিশন প্রধান সুচিয়াং সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরডটকমকে বলেন, বিস্ফোরণের পর সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটি হলো পানির স্তর শুকিয়ে যাওয়া। বিস্ফোরণের আগে লাউয়াছড়ার কোনো ছড়ার পানি শুকায়নি। এমনকি খরার দিনেও পানি থাকত। কিন্তু বিস্ফোরণের পর শুকনার সময় তো দূরের কথা, বর্ষাতেও ছড়ায় পানি থাকে না।

 ছবি: সংগ্রহ

এদিকে ক্ষতিপূরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে পরিবেশবাদীসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন। দাবি আদায়ে তারা শান্তিপূর্ণভাবে লংমার্চ, মানববন্ধন, পদযাত্রা, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। এবারও বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে।

এ ব্যাপারে মাগুরছড়ার গ্যাসসম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি জানায়, আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্য শেভরনকে নোটিস প্রদান ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তির নিমিত্তে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদায় না হবে ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আর ক্ষতিপূরণ আদায় হলেও মাগুরছড়া দিবস হিসেবে পালন করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত