সিলেটটুডে ডেস্ক

০৯ জুন, ২০১৫ ১৭:১৫

১০ মাসে পিডিবির লোকসান প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা

বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে তা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমে আসার কথা। এছাড়া মেয়াদ বাড়ানোয় ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বছরে কয়েকশ কোটি টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে। তার পরও চলতি অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটিকে গত অর্থবছরের চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে।

লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উৎপাদন বৃদ্ধিকেই দায়ী করছে পিডিবি। যোগাযোগ করা হলে পিডিবি চেয়ারম্যান শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে ব্যয় কিছুটা কমেছে। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো তেল আমদানি করেও লোকসান কমাতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মধ্যে প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বাড়তি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে উৎপাদন বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে লোকসানও।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর পরের অর্থবছরই লোকসান অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ২০১০-১১ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান করে ৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর লোকসান আরো বেড়ে হয় ৬ হাজার ৩৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোকসান আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা কমে। অর্থবছরটিতে পিডিবির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর তা আবারো বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকায়। আর চলতি অর্থবছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

উৎপাদন বৃদ্ধির কারণেই চলতি অর্থবছর লোকসান বেড়েছে বলে দাবি পিডিবির। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রমতে, গত অর্থবছর পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রায় ৪ হাজার ২২০ কোটি ইউনিট। আর চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ২৬৯ কোটি ইউনিট। এ হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট উৎপাদন সাড়ে ৪ হাজার কোটি ইউনিট ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস থেকে এসেছে ৬৮ দশমিক ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ। যদিও অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে তেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছে পিডিবি।

উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে লোকসান বেড়ে যাওয়ার দাবির সঙ্গে একমত নন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলে ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) দিতে হয়। এ হিসাবে উৎপাদন বাড়লে ইউনিটপ্রতি ব্যয় কমে যাওয়ার কথা। বাড়ার কোনো কারণ নেই। বেসরকারি খাতের চুক্তিগুলোয় অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে। এ কারণেই এমনটা হচ্ছে। কারিগরি অডিট ছাড়া এটা রোধ করা যাবে না।

লোকসান ঠেকাতে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করে পিডিবি। তাদের প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানিও হয়। শুনানিতে পিডিবির ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ প্রস্তাবের বিপরীতে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর পক্ষে মত দেয় বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। যদিও জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতনের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেন বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহক-প্রতিনিধি। এর পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানায়নি কমিশন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ সাশ্রয়ের কথা জানিয়ে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ পাঁচ বছর করে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বহাল রাখা হয়েছে। তাই অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। নির্ধারিত সময় পর এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হলে লোকসান কমে যেত। এছাড়া বেসরকারি খাতের তেল আমদানিকারক কেন্দ্রগুলোর দেয়া তেলের বিল সম্পর্কিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে না পিডিবি। ফলে কম দামে তেল কিনে পিডিবির কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করে নেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়ে না।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মুস্তাক আহমেদ বলেন, বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে লোকসানও বাড়ে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র উৎপাদনে এলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

পিডিবি সূত্র জানায়, সেচ মৌসুম লোডশেডিং মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে সংস্থাটি। এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় গত কয়েক মাসে ব্যয়বহুল রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপিভিত্তিক বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ইউনিটপ্রতি ৮-১৫ টাকা খরচ হয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি পায় ৪ টাকা ৭০ পয়সা। তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানো হয়েছে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে অতিরিক্ত এ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে লোকসান বেড়ে গেছে সংস্থাটির। বৃষ্টি হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। তাতে লোকসানের পরিমাণ কমতে পারে বলে মনে করছেন পিডিবি কর্মকর্তারা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, একাধিক কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুেকন্দ্রের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় লোকসান বেড়ে যাচ্ছে।


সূত্র : বণিক বার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত