যুগান্তর

২৬ আগস্ট, ২০১৮ ১৩:১৩

৫৯ বাংলাদেশির নামে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট

ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টে ঝুলছে ৫৯ বাংলাদেশির নাম। তাদের কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, কেউ গডফাদার। কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধী। আবার কেউ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি। এ তালিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও। বছরের পর বছর তারা গা-ঢাকা দিয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতেই বাংলাদেশ থেকে ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। ইন্টারপোল তাদের ওয়েবসাইটে এসব অপরাধীর নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে।

বর্তমানে তালিকায় থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে নানা জটিলতার কারণে বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়েও এসব অপরাধীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশে যাদের নাম রয়েছে তারা হল- রফিকুল ইসলাম, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, আবদুল জব্বার, নবী হোসাইন, জিসান, তৌফিক আলম, মিন্টু, শাহাদাত হোসাইন, আতাউর রহমান, নাসির উদ্দিন রতন, চাঁন মিয়া, প্রশান্ত সরদার, সুলতান সাজিদ, হারুন শেখ, মনোতোষ বসাক, আমিনুর রহমান, গোলাম ফারুক অভি, রাতুল আহমেদ বাবু, হাসন আলী ওরফে সৈয়দ মো. হাছন, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে হোসেন, জাহিদ হোসেন খোকন, আবদুল হারিস চৌধুরী, আবদুল জব্বার, আহমেদ কবির ওরফে সুরত আলম, রফিকুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন খান, হাসেম কিসমত, শরিফুল হক ডালিম, মোল্লা মাসুদ, মো. ইউসুফ, মো. নাঈম খান ইকরাম, মকবুল হোসাইন, সালাহউদ্দিন মিন্টু, খন্দকার আবদুর রশিদ, মঈন উদ্দিন চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আলহাজ মাওলানা মো. তাজউদ্দিন মিয়া, আশরাফুজ্জামান খান, খোরশেদ আলম, মোহাম্মদ চৌধুরী আতাউর রহমান, ত্রিমতি সুব্রত বাইন, আবুল কালাম আজাদ, সৈয়দ, আমান উল্লাহ শফিক, নুরুল দিপু, আহমেদ মঞ্জু, চন্দন কুমার রায়, এএম রাশেদ চৌধুরী, মোসলেহ উদ্দিন খান, নাজমুল আনসার, আবদুল মাজেদ, আহমেদ শারফুল হোসাইন, কালা জাহাঙ্গীর ওরফে ফেরদৌস, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, শামীম আহমেদ।

ইন্টারপোলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে ওয়ান্টেড ব্যক্তিরা পলাতক। রেড নোটিশের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানা এবং গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। ওই ব্যক্তিরা যে দেশে দোষী সাব্যস্ত হয় সেই দেশে প্রত্যর্পণে সহায়তা করে ইন্টারপোল।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য পদ গ্রহণ করে। তবে পুলিশের আন্তর্জাতিক এ সংস্থার রেড নোটিশ কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়। ইন্টারপোল আসামিকে গ্রেফতারে কোনো বাহিনী পাঠায় না বা কোনো দেশকে চাপও দিতে পারে না। তারা শুধু এ সংক্রান্ত তথ্য ১৯০টি সদস্য দেশকে জানায়।

ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টে রয়েছে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম। তাদের মধ্যে প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, আবদুল জব্বার, নবী হোসাইন, জিসান, শাহাদাত হোসাইন, মোল্লা মাসুদ, ত্রিমতি সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর ওরফে ফেরদৌস, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়সহ রেড অ্যালার্টে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বছরের পর বছর ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের অপরাধ সাম্রাজ্য। তাদের নামে মাসে কোটি কোটি টাকার নীরব চাঁদাবাজি হচ্ছে।

ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টে থাকা এবিএম নুর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশিদ, আবদুল মাজেদ, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। মোসলেহ উদ্দিন জার্মানিতে, নূর চৌধুরী কানাডায়, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, আবদুর রশিদ ও মাজেদ পাকিস্তানে এবং ডালিম লিবিয়ায় রয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তথ্য রয়েছে। আর মাওলানা তাজউদ্দিন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে রেড অ্যালার্টে রয়েছে ফরিদপুরের আবুল কালাম আজাদ, জাহিদ হোসেন, গোপালগঞ্জের আশরাফুজ্জামান খান, ফেনীর মইনউদ্দিন চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ মো. হাসান আলী ও সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন এবং মঠবাড়িয়ার আবদুল জব্বারের নাম। রয়েছে বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর নামও। এছাড়া মডেল তিন্নি হত্যা মামলার আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির নামও রেড নোটিশে ঝুলছে। খবর রয়েছে গোলাম ফারুক অভি ও হারিছ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

তবে ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত কয়েকজনকে ফিরিয়ে এনেছে সরকার। সর্বশেষ ফিরিয়ে আনা হয় নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নূর হোসেনকে। তিনি ভারতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নাজমুল মাকসুদ মুরাদকে। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপের মামলার আসামি মুরাদ।

পুলিশ সদর দফতর বলছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকার পরও বিদেশে পলাতক আসামিদের দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া আটকে আছে নানা জটিলতায়। এজন্য সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আবার এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে দেশের বাইরে থেকেও বিভিন্ন চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশ শীর্ষ সন্ত্রাসী বা আলোচিত মামলার আসামিদের ব্যাপারে কেবল রেড অ্যালার্ট জারি এবং ইন্টারপোলে নাম-ছবি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। কে কোথায় অবস্থান করছে, কীভাবে তাদের গ্রেফতার করা যায়, তা নিয়ে পুলিশের তথা সংশ্লিষ্ট কারও তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি কিংবা চাঞ্চল্যকর ঘটনার হোতারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েই যেন গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কোনো মতে দেশের সীমানা পার হলেই তারা পেয়ে যাচ্ছে নিরাপদ জগৎ। এভাবে মোস্ট ওয়ানটেড সন্ত্রাসী গডফাদাররা পালিয়ে যায়, কিন্তু ওদের আর হদিস মেলে না।

আর এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বিদেশে পলাতক চিহ্নিত অপরাধীরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না; ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে। সবার নজর ভারতের দিকে থাকায় সন্ত্রাসীরা এখন নেপাল, ভুটান, দুবাই, থাইল্যান্ডসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও আশ্রয় নিচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাকে বিভ্রান্ত করতে এসব সন্ত্রাসী এক দেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করে পার্শ্ববর্তী দেশের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করছে। ওইসব স্থানে অবস্থান করে বাংলাদেশে নিজ নিজ এলাকায় তারা মুঠোফোনে সহযোগীদের মাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদ্যমান নিয়ম-কানুন মেনেই বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে পারে। তার মতে, আসামিদের ফেরতে একটি বড় বাধা সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকা বা সে দেশের আইন। তবে এরপরও কিছু ক্ষেত্রে আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়টি নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর।

আর পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করা আছে, আমরা তাদের বিষয়ে ইন্টারপোলের কাছ থেকে সার্বক্ষণিক আপডেট নিয়ে থাকি। আসলে রেড অ্যালার্ট জারি করার অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে শনাক্ত করা। শনাক্ত করে তাদের লোকাল আইনি হেফাজতে নিয়ে আসা। তারপর আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে হস্তান্তর করা। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার কারণেই কিছু দীর্ঘসূত্রতার বিষয় এসে যায়। এখানে সরাসরি বাংলাদেশ পুলিশের করণীয় কিছু নেই।

খবর: যুগান্তর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত