সিলেটটুডে ডেস্ক

৩১ আগস্ট, ২০১৯ ০২:১৮

গোলাম সারওয়ার ছিলেন সাংবাদিকতার বাতিঘর

গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নাগরিক স্মরণসভা

সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত নাগরিক স্মরণসভার শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়

সাংবাদিকতায় সততা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে গেছেন গোলাম সারওয়ার। সেই আলো পথ দেখাবে আগামীকে। সাংবাদিকতা প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করে পেশাগত উৎকর্ষে সমুজ্জ্বল হবে। সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু হয় না। সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকেন। গোলাম সারওয়ার ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার বাতিঘর।

সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নাগরিক স্মরণসভায় এসব কথা বলেছেন বিশিষ্টজন। স্মরণসভার শুরুতেই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার গত বছরের ১৩ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। স্মরণসভায় গোলাম সারওয়ারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ ও তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা করেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

স্বাগত বক্তব্যে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকেন কর্মের মধ্য দিয়ে।

গোলাম সারওয়ার যে পথ দেখিয়ে গেছেন- সেই পথ দিয়ে চলছে সমকাল। গোলাম সারওয়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা বলতেন। সমকাল আজীবন সে কথাগুলো বলে যাবে।

সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, গোলাম সারওয়ারের মতো একজন ছাত্র পেয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে গর্বিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক ষাটের দশকের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৬৩ সালে বাংলা বিভাগ বাংলা ভাষা, সাহিত্যের হাজার বছরের উৎসব পালন করে। সে সময়ে যে ক'জন ছাত্র এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তাদের অন্যতম গোলাম সারওয়ার। সারওয়ার নেই তা মনে হয় না। সে ছিল, আছে, থাকবে। কারণ, গোলাম সারওয়ার একজন ভালো মানুষ ছিল।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, গোলাম সারওয়ার আজীবন লড়াকু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। রাজনীতিকদের প্রশংসা করতেন, আবার কড়া সমালোচকও ছিলেন।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, গোলাম সারওয়ার উঁচু মাপের একজন মানুষ ছিলেন। তার দেখানো পথে দেশের সাংবাদিকতা আগামীতে প্রতিটি ক্রান্তিকাল পেরিয়ে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনও ক্রান্তিকালই যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় তারও প্রত্যাশা করেন তিনি।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতায় যেমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার প্রচেষ্টায় তার এলাকায় স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, গোলাম সারওয়ারের প্রতি সম্মান জানানোর একটিই উপায়, তা হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রসার, সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্য কথা বলা। তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ারের অনুপ্রেরণাতেই সম্পাদক পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়, তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

জাগরণ সম্পাদক আবেদ খান বলেন, গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে তিনি একসঙ্গে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। তাদের অনেক স্মৃতি। এখন সাংবাদিকতা স্থবির হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গোলাম সারওয়ারকে অনুসরণ করে তা যদি সার্বিকভাবে ক্যামেরা এবং ভাষায় প্রয়োগ করা যায়, তাহলেই কেবল এই ক্ষয়রোধ সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, 'কৌশল এমন একটি শিল্প, আপনি কাজ করবেন কিন্তু শত্রু তৈরি হবে না'- এই আদর্শের সার্থক মানুষ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি কাজ করেছেন সারাজীবন, কিন্তু কারও বিরাগভাজন হননি। তিনি শুধু সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। যা বিশ্বাস করতেন, তা অনুসরণ করতেন।

পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গোলাম সারওয়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গভীরভাবে ধারণ করতেন এবং এ চেতনায় দেশ গড়ায় তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ভালো সাংবাদিকের পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ ছিলেন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, গোলাম সারওয়ারের তুলনা হয় না। তিনি হৃদয়ের মানুষ, আত্মার চেয়েও নিকটতম মানুষ। তিনি রিপোর্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন। সংবাদপত্রে কৌশলী রিপোর্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে তার তুলনা তিনিই। তিনি বিরোধী মতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সমাজ থেকে যখন সত্য গুম হয়ে যায়, মানবিক মূল্যবোধ যখন উধাও হয়ে যায়, তখন গোলাম সারওয়ারের মতো একজন উঁচু মাপের সাংবাদিক খুবই প্রয়োজন।

সমকাল প্রকাশক ও এফবিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, আপাদমস্তক পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন গোলাম সারওয়ার। সবচেয়ে কঠিন পেশা সাংবাদিকতা করেছেন সাহসের সঙ্গে। কোনও সংবাদ কারও পক্ষে গেলে, তা তার প্রাপ্য মনে করেন। কিন্তু বিপক্ষে গেলে যেভাবে পারে সংবাদপত্রের মালিককে দেখে নিতে চান। গোলাম সারওয়ার সংবাদ প্রকাশে আপস করতেন না। তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন, তা বেঁচে থাকুক। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে এই আদর্শের অভাব রয়েছে। আপস করতে করতে সাংবাদিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, মানুষ আর পত্রিকা পড়তে চায় না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, গোলাম সারওয়ার যখন ইত্তেফাকে ছিলেন, তখন ইত্তেফাক পড়তাম। এরপর তিনি যুগান্তরে গেলেন, যুগান্তর পড়তে শুরু করি। সমকাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সমকাল পড়তে শুরু করলাম। এর অর্থ গোলাম সারওয়ার যেখানে যেতেন, তার সঙ্গে সেখানে পাঠকরাও যেতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সংবাদ প্রকাশ, উপস্থাপন এবং সৃজনশীল শিরোনাম দেওয়ার ক্ষেত্রে গোলাম সারওয়ার ছিলেন অনন্য। তিনি ভালো মানুষ, ভালো শিক্ষক এবং ভালো সাংবাদিক ছিলেন।

নাট্যজন আতাউর রহমান প্রিয় বন্ধু গোলাম সারওয়ারের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনান।

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, আজকে সাংবাদিকতায় এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। গোলাম সারওয়ার থাকলে হয়তো এই শূন্যতা কাটিয়ে ওঠা সহজ হতো।

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন নির্ভীক, নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্র ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, গোলাম সারওয়ার তার অভিভাবক ছিলেন। তার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছেন যে অন্তরে ঘৃণা লালন করে, তার দহন হয় বেশি।

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক যখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, তখন গোলাম সারওয়ার পাশে ছিলেন, সাহস যোগাতেন। গোলাম সারওয়ারের সাহস ছিল। সেই সাহস নিয়ে সাংবাদিকতা করতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

কবি কামাল চৌধুরী বলেন, গোলাম সারওয়ার বহুমুখী প্রতিভায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে।

তথ্য সচিব আবদুল মালেক বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পিআইবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন গোলাম সারওয়ার। সেই সুবাদে গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে সখ্য। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই সুবিশাল ব্যক্তিত্বের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন বাইরে কাদার মতো নরম। কিন্তু ভেতরটা দৃঢ় কঠিন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক।

ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুলিশ-সাংবাদিকের সম্পর্ক অম্ল-মধুর। কখনও কখনও সংকট সৃষ্টি হয়। সংকটে অভিভাবকতুল্য গোলাম সারওয়ারের সাহায্য নিতেন তিনি।

বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, তিনি যথার্থ অর্থে সম্পাদকের পাশাপাশি সাংবাদিকতার শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনকে তৈরি করা মানুষ গোলাম সারওয়ার। গণমাধ্যমে যে ক্ষয়িষ্ণুতা সৃষ্টি হয়েছে তা রোধে গোলাম সারওয়ারের আদর্শের বিকল্প নেই।

প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতার বাতিঘর ছিলেন।

গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, এসিআইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর, বিএফইউজে মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত, ডিআরইউ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন।

সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ এই স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ার, বিটিভির পরিচালক (বার্তা) কবি নাসির আহমেদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএস আমিন উদ্দিন, দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক কবীর আহমেদ খান, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক জাহাঙ্গীর খান, কথাসাহিত্যিক মুজতবা আহমেদ মোরশেদ, কবি মাহমুদ হাফিজ, অভীক সানোয়ার রহমান, লেখক হাবিব আনিসুর রহমান, নাসিমা আনিস প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে গোলাম সারওয়ার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তার সহোদর গোলাম হায়দার, জামাতা মিয়া নাইম হাবিব এবং ভাগ্নে শামীম হাসান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত