তপন কুমার দাস, বড়লেখা

১১ অক্টোবর, ২০১৫ ২০:৩৭

বড়লেখায় দিনে রেকির পর রাতে ডাকাতি: গ্রেফতারকৃত ডাকাতদের বয়ান

যে দোকানে বা বাসায় ডাকাতি হবে সাধারণের বেশে দিনের বেলা সেটি পর্যবেক্ষণ করে গিয়ে রাতেই হয় অপারেশন। অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ডাকতদের একেকজনের থাকে একেক দায়িত্ব। একদল দিনের বেলা রেকি করে লক্ষ ঠিক করে, অন্য দল সাজায় অপারেশন পরিকল্পনা। আর অস্ত্র মজুদে ব্যস্ত থাকে আরেকদল। এভাবেই খোদ পৌর শহরে বসেই হত ডাকাতির মাস্টার প্লান। গ্রেফতারকৃত  ডাকাতরা পুলিশের কাছে দিয়েছেন এমনই তথ্য।

বড়লেখায় সাম্প্রতিক সময়ে আশংকাজনকভাবে চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ আতংক শুরু হয়। গত তিন সপ্তাহে ১০টি চুরি ডাকাতির ঘটনায় অন্তত ৬০ লাখ টাকার মালামাল লুট হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হয়েপড়ে দিশেহারা,  ডাকাতির সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে যখন হিমশিম খাচ্ছে তারা তখনই জনমনে কিছুটা স্বস্তির  কারণ হিসেব আসে ৫ ডাকাতের গ্রেফতারের সংবাদ। পুলিশের সাড়াশি অভিযানে গ্রেফতার হয় ৫ কুখ্যাত ডাকাত।

৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা। পুলিশের কাছে গোপন সংবাদ আসে রাতে চান্দগ্রামে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে ডাকাতরা। পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চান্দগ্রাম এলাকায় অভিযানের প্রস্তুতি নেয় অফিসার ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে। এর পর রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে বড়লেখা উপজেলার চান্দগ্রামের টুকা এলাকা থেকে পুলিশ অস্ত্রসহ আন্ত:জেলা ডাকাত দলের ৫ ডাকাতকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও আরও কয়েকজন ডাকাত পালিয়ে যায়। ডাকাতির হাত থেকে রক্ষা পায় আরও একটি পরিবার।

গ্রেপ্তারকৃত ডাকাতরা হলো-বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের গাংকুল গ্রামের মৃত রমেশ দাসের পুত্র প্রণেশ দাস (৩২) ও উত্তর শাহবাজপুর ইউপির নান্দুয়া গ্রামের মৃত কুটন আলীর পুত্র জয়নাল উদ্দিন (৩১) এবং সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার কোনাগাও গ্রামের সোনাহর আলীর পুত্র শাহনাজ আহমদ (২৮) একই গ্রামের ফরমান আলীর পুত্র শামীম আহমদ (২২) ইদ্রিছ আলীর পুত্র নজরুল ইসলাম (২৮)।

পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে তিন রাউন্ড বন্দুকের গুলি, এসিডের বোতল, সিরিঞ্জ, চারটি লম্বা দা, ১টি তালাভাঙার যন্ত্র, ২টি ছোরা, দুটি মুখোশ ও দুটি টর্চ লাইট, নগদ ১ হাজার ৬২ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এর পর পুলিশ ডাকাতদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত ডাকাতরা বড়লেখা এলাকার তাদের সহযোগীদের নাম ঠিকানা পুলিশকে দেয়। এ সংবাদের উপর ভিত্তি করে পুলিশ ডাকাতদের সাথে নিয়ে রাতভর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ডাকাত ও অন্যান্য ডাকাতদের পাওয়া যায়নি।

১০ অক্টোবর পুলিশ ডাকাতদের থানায় দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ডাকাতরা বড়লেখা, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট, জকিগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় ঘটে যাওয়া ডাকাতির ঘটনার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতরা পৌর শহরের হাটবন্দ, তেলিগুল, পৌর শহরের স্বর্ণের দোকানে চুরিসহ কয়েকটি ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত ডাকাতরা জিজ্ঞাসাবাদে বড়লেখায় তাদের সহযোগী ডাকাত ও সর্দারেরও নাম বলে। ডাকাতদের ওই সর্দার বড়লেখার একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত সহযোগী বলে পুলিশকে জানায় ডাকাতরা। গ্রেফতারকৃত ডাকাতদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে ২টি মামলা দায়ের করে। গ্রেফতারকৃতদের আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে। পরবর্তীতে অন্যান্য মামলায়ও রিমান্ড আবেদন করা হবে বলে পুলিশ সুত্র জানায়।

বড়লেখায় ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার সাথে গ্রেফতারকৃতদের যোগসূত্র : সাম্প্রতিক সময়ে বড়লেখায় ঘটে যাওয়া ডাকাতি ও চুরির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত যোগসূত্র খোঁজে পেয়েছে পুলিশ। থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী ডাকাতির পরিকল্পনা হতো পৌর শহরের দক্ষিণ বাজার এলাকার একটি রেস্টুরেন্ট ও কয়েকটি গাড়ি ষ্ট্যান্ডে। ডাকাতদের দেওয়া তথ্য ও মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা তথ্য যাচাইয়ে মাঠে নামে পুলিশ। এসময় এ যোগসূত্রের সত্যতা পাওয়া যায়। গ্রেফতারকৃতরা একই গ্রুপের সদস্য।

 গ্রেফতারকৃতদের এক ডাকাত জয়নাল উদ্দিন। সে বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউপির নান্দুয়া গ্রামের মৃত কুটন আলীর পুত্র। প্রায় এক বছর পূর্বে পৌর শহরের একটি ভবনে পাহারাদারের কাজ করত। আনুমানিক ৬ মাস পাহারাদারের কাজ ছেড়ে দেয়। গত সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখে পৌর শহরের মৃত আব্দুল করিমের চার তলা বাসার ২য় তলায় ভাড়া নেয় জয়নাল। আগের স্ত্রীকে ১ মেয়ে সহ তালাক দিয়ে ০৬ সেপ্টেম্বর বিয়ে করে জুড়ী উপজেলায়। তার ২য় স্ত্রী পৌর শহরের এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত। হাটবন্দ এলাকার বাসায় বসবাসের সময় স্থানীয় ও বাসার বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জয়নাল এক মাসে ৩ রাতে বাসায় আসেনি। দিনে সে কোথাও বের হতো না। সে গ্রেফতার হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদ প্রকাশের পর তার সম্পর্কে বের হয় অনেক অজানা তথ্য। চুরি হওয়া দোকানদারা তাকে দেখে সনাক্ত করেন। ডাকাতি ও চুরি হওয়া প্রতিটি দোকান আগে রেকি করত ডাকাতরা।

কেস স্টাডি-১ : গ্রেফতারকৃত জয়নাল উদ্দিন। চলতি বছরের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ জয়নাল ডাকাত পৌর শহরের দক্ষিণ বাজারের অপর্ণা জুয়েলার্সে যায় একটি নূপুর তৈরি করার জন্য। এসময় তার সাথে তার এক বোন ছিল। অপর্না জুয়েলার্সের মালিককে জানায়, সে নতুন বিয়ে করবে। এভাবে ৩দিন সে ওই দোকানে যায়। দোকানদারের সাথে তার গড়ে উঠে সখ্যতা। ২ হাজার টাকা মূল্যের নূপুর সে ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে নিয়ে যায়। দোকানদারের দেওয়া তথ্য মতে ২৫ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সে নূপুর নেয়। এর পর ১০ সেপ্টেম্বর অপর্ণার টিন কেটে দোকান চুরি হয়।

কেস স্টাডি-২ : ঈদুল আজহার ৩দিন পূর্বে পর পর ২দিন চুরি হওয়া টাঙ্গাইল মুসলিম জুয়েলার্সের ৪র্থ শাখায় স্বর্ণের চেইন বিক্রি ও একদিন ক্রয় করতে গিয়ে দর দাম করে জয়নাল ডাকাত। এর পর ঈদের পর অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বর ৪র্থ শাখায় দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। সঙ্গবদ্ধ চোরেরা প্রায় ৬৬ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ৭ ভরি রোপা, ৩ হাজার ২’শ টাকাসহ প্রায় ২৬ লাখ টাকার মালামাল চুরি করে নিয়ে যায়।

কেস স্টাডি-৩ :  ৭ অক্টোবর রাতে পৌরশহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোপাল পালের বাসায় ডাকাতরা হানা দিয়ে পাঁচ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এসময় ডাকাতিতে বাঁধা দিতে গিয়ে গৃহকর্তা গোপাল পাল ও স্ত্রী শিখা রানী পাল ডাকাতদের হামলায় আহত হন। ২৭ সেপ্টেম্বর পৌর শহরের হাটবন্দের জয়নালের বাসায় দুপুরে আসে গোলাপগঞ্জের ফরমান আলীর পুত্র শামীম আহমদ ও বড়লেখা উপজেলার তাদের সর্দার (নাম অপ্রকাশিত রাখা হলো)। এ বাসায় বসে তারা ডাকাতির ঘটনার পরিকল্পনা করে। পৌর শহরের ডাকাত কবলিত বাসার বাসিন্দা ব্যবসায়ী গোপাল পালের ছেলের ঢাকা মিষ্টি ঘর-২ নামক দোকান থেকে বিয়ে করার কথা বলে জয়নাল মিষ্টি ক্রয় করে সম্প্রতি। এ দোকানদারের সাথেও সখ্যতা গড়ে ৫’শত টাকা বাকি রাখে। পুলিশের কাছে অন্যান্য ঘটনা ছাড়াও এ তিনটি ঘটনার সাথেও তারা তাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সম্প্রতি বড়লেখায় বিভিন্ন ডাকাতির সাথে তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এছাড়া এরা সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলাসমূহে ঘটে যাওয়া ডাকাতির ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এদের জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদেরকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।


আপনার মন্তব্য

আলোচিত