গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি

১৩ আগস্ট, ২০২০ ১২:২৭

কৃষিতে প্রতিবন্ধী দিদারুলের সাফল্য

সিলেটের গোয়াইনঘাটে কৃষিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে সফল হয়েছেন এক শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ। তার এমন সফলতায় নিজের পাশাপাশি উপকৃত হচ্ছে পরিবার। উপজেলার কৃষিতেও যোগ হচ্ছে তার উৎপাদিত ফসল থেকে আসা টাকাও। নিজের পরিবারকে কৃষিতে জড়িয়ে সন্তুষ্ট তিনি। তাকে দেখে কৃষিতে উৎসাহিত হচ্ছেন এলাকার অনেকেও। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় আশপাশেও রয়েছে তার কৃষি সফলতার জয়গান। যাকে নিয়ে এমন কথা তিনি হলেন গোয়াইনঘাটের তুরন শারীরিক প্রতিবন্ধী কৃষক দিদারুল। তার পুরো নাম দিদারুল আলম।

জন্মের পরই আর্টারি ভেনাস মেলফরমেশন (এভিএম) নামের একটি ভাইরাসজনিত রোগের কারণে ২০১৪ সালে এসে কৈশোরে তার একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই থেকে তার একটি হাত নেই। সিলেটের এমসি কলেজের স্নাতকে অধ্যয়নরত মেধাবী এ শিক্ষার্থী। সিলেটের গোয়াইনঘাটের সীমানা দিগন্তে ফতেহপুরে গুলনি গ্রামে তার বাড়ি।

চাকরির খোজে বহু সময় নষ্ট করে ক্লান্ত তিনি। অবশেষে এ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসেন। ২০১৬ সাল থেকে বাবা আর ছোট ভাইদের সহযোগিতায় বাড়ি আর বাড়ির আশপাশের জমিকে বেছে নিয়ে শুর করেন কৃষিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মিশন। এমনিই হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার রোপায়িত বাগানে আছে পেঁপে, জারা লেবু, বাতাবি লেবু, কলম্বো লেবু, এলাচি লেবু, লটকন, মাল্টা। শসা, কাচ কলা, ঝিঙ্গা, ধুন্দল, পুই শাক, কচুর মুখি, লতি, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, লাল শাক, আদা, হলুদসহ সময় ও আবহাওয়া উপযোগী শাকসবজি থাকে বছর জুড়ে। বাড়িতে একটি ঘরে বেশকটি গরুর সমন্বয়ে একটি দেশি গরুর খামার রয়েছে। শতাধিক কবুতর, টার্কি, রাজহাঁস এবং দেশি হাস-মুরগির অবাধ বিচরণও চোখে পড়ে।

নানা জাতের ফলমূল ও কাঠ গাছের সমন্বয়ে বিশাল একটি নার্সারির (বাগান) করেও সফলতা আছে তার নামের বিপরীতে। ৪ একর ফসলি জমিতে নানা জাতের ধান রোপণ করেছেন। সেখানে সবুজের আস্তরণে ধানের চারা আর শীষ যেন দোল খাচ্ছে বাতাসের সাথে।

উপজেলা কৃষি অফিসার সুলতান আলীসহ অপরাপর উপ-সহকারী কৃষি অফিসারদের সাথে সরেজমিনে গেলে ফুটে উঠে কৃষিতে তার সফলতার গল্প। উপজেলার ৬নং ফতেহপুর ইউনিয়নের গুলনি গ্রামের তার পুরো বাড়িতে দেখা যায় নানা জাতের ফল ফসলের ভাণ্ডার। টিলাময় বাড়ির চারপাশে লটকন, জারা লেবু, মাল্টার গাছে দীর্ঘ সারি। সারিবদ্ধ মাল্টার গাছগুলো ছোট ছোট ফল আর ফুলে ভরে ওঠেছে। বাড়ির নিচেই ঢালু জমিতে চোখে পড়লো ৩-৪ ফুট উচ্চতা সাইজের শতাধিক পেঁপে গাছ। মাথা নিচু করে পেঁপে বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ে পেঁপের সারি সারি থোকা। প্রতিটি গাছেই পেঁপেতো টইটম্বুর। বাইরে চিরসবুজ কিন্তু ভেতরটা লাল রক্তিম রেডলেডি জাতের এই পেঁপে চাষে তিনি ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। উন্নত জাতের বীজের চারায় সৃজিত তার বাগানের রোপায়িত পেঁপের ফলনও বাম্পার হয়েছে।

পেঁপের পাশাপাশি টিলা শ্রেণির ৩ একরের তার বাড়ির চতুর্দিকে রয়েছে মাল্টা আর জারা অগণিত জাতের লেবুর গাছ। প্রতিটি গাছে ঝুলে রয়েছে জারা লেবু আর মাল্টা।

একান্ত আলাপচারিতায় শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ কৃষক দিদারুল আলম জানান, আমি ছোট বেলা থেকে কৃষিতে নিজেকে জড়াতে চেষ্টা করে আসছিলাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরির জন্য বহু জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করেছি। কোথাও সুযোগ পাইনি। চাকরি না পেলেও দমে থাকিনি কিংবা ভেঙ্গে পড়িনি। চেষ্টা করি নিজে থেকে কিছুর করার। অবশেষে নিজের শারীরিক অসঙ্গতি সত্যেও জড়িয়ে পড়ি কৃষিতে। চাকরি না হওয়ার আক্ষেপ না করে নিজে থেকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করি। আমার বাবা-মার প্রেরণা আর উৎসাহে কৃষি কাজের মাঝেই এখন থাকি সব সময়। প্রথম প্রথম লোকসান হলেও এখন এ খাত থেকে বছরে কয়েক লক্ষাধিক টাকা আসে। বর্তমানে রেডলেডি পেঁপের ফলন থেকেও ভালো বিকিকিনি আসছে। চাহিদাও আছে। তাছাড়া টিলায় রোপিত মাল্টার ফলনও ভালো হয়েছে। শেষ অবধি ফলগুলো ঝরে না পড়লে এখান থেকেও ভালো আয় আসতে পারে। উপজেলা কৃষি অফিস সব সময় আমার পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

তার বাবা জামাল উদ্দিন জানান, আমার পরিবার মূল থেকেই কৃষি নির্ভর। আমার ছেলে দিদারুল লেখাপড়া করে চাকরি করবে এমনটা স্বপ্ন ছিলো। বহু চেষ্টার পর চাকরি না হওয়ায় এক সময় সে নিজেই কৃষিতে জড়ায়। একটি হাত না থাকায় আমরা সবাই তাকে সহযোগিতা করি। তার মাধ্যমে কৃষিতে আমার পরিবারের সচ্ছলতার গল্পও রচিত হচ্ছে।

গোয়াইনঘাটে উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সুলতান আলী জানান, গোয়াইনঘাটের ফতেহপুরের গুলনি এলাকার প্রতিবন্ধী তরুণ কৃষক দিদারুল আলমের কৃষি ব্যবস্থাপনায় আমাদের সার্বিক সহযোগিতা ও নজরদারি আছে। তা যে কোন সহযোগিতায় উপজেলা কৃষি বিভাগ সব সময়ই পাশে থাকবে।

এ ব্যাপারে কথা হলে গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাজমুস সাকিব বলেন, গোয়াইনঘাটের ফতেহপুরের প্রতিবন্ধী তরুণ কৃষক দিদারুলের খবর শুনেছি। তার কৃষিতে জড়ানো একটি মাইলফলক ও ভালো খবর বটে। তার কৃষি খামার পরিদর্শন করবো এবং তাকে সরকারের তরফ যে কোন সহযোগিতায় উদ্যোগ নিবো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত