শাকিলা ববি

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:৫৪

সিসিকের পরিধি বৃদ্ধি নিয়ে নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে

সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)-এর পরিধি বাড়ানোর জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। এই গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। অনেক এলাকা সিটি করপোরেশনের অর্ন্তভূক্ত হওয়ার দাবি জানিয়েছে। আবার কিছু এলাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে থাকতে আন্দোলনে নেমেছে।

এসব দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন কিংবা স্মারকলিপি প্রদানের ঘটনা ঘটছে।

জানা যায়, গত ৯ আগস্ট সিসিক সম্প্রসারণের উদ্যোগের অংশ হিসেবে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সিলেট জেলা প্রশাসন। সিলেট সিটি করপোরেশনকে প্রায় ৫৭ বর্গকিলোমিটারে উন্নিতের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এই গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে সিসিকের আয়তন রয়েছে ২৬ বর্গকিলোমিটার।

তবে গত ১৯ আগস্ট সিলেট সিটি করপোরেশনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাংসদ ড. একে আব্দুল মোমেনও বলেন, সিলেট নগরের আয়তন আট গুণ বাড়ানো উচিত। বর্তমান গণবিজ্ঞপ্তিকে বিপর্যয়কর বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রকাশিত গণবিজ্ঞপ্তিতে সিটি করপোরেশনের আয়তন মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বর্ধিত না হওয়ার কথা জানিয়েছেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানিয়েছিলেন, গেজেটেড মাস্টারপ্ল্যানে সিসিককে সম্প্রসারণ করে ৮৫.১৫ বর্গকিলোমিটারে উন্নিত করার নির্দেশনা রয়েছে।

গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই নগরের আশপাশের অনেক এলাকায় ক্ষোভ দেখা দেয়। দক্ষিণ সুরমার কুচাই ইউনিয়নসহ কয়েকটি ইউনিয়ন ও সদরের কয়েকটি ইউনিয়ন সিটির আওতায় আসতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। আবার সদর উপজেলার খাদিম নগর ইউনিয়নসহ কিছু কিছু এলাকা সিসিকের আওতার বাইরে থাকতে বিক্ষোভ করছে।

গণবিজ্ঞপ্তিতে সদর উপজেলার ৪নং খাদিমপাড়া ইউনিয়নকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অর্ন্তভূক্তের প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। তবে এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের অনেকে সিটির অর্ন্তভূক্ত না হতে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকেই বিক্ষোভ করে আসছেন। শনিবারও (৫ আগস্ট) তারা একই দাবিতে খাদিমপাড়ায় মানববন্ধন করেন।

বিজ্ঞাপন



একই দিনে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের টুকেরগাঁও, গৌরিপুর ও নোয়াগাঁওকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এলাকাবাসী।

প্রকাশিত গণবিজ্ঞপ্তিতে দক্ষিণ সুরমার কুচাই ইউনিয়নের কিছু এলাকাকে সিটি করপোরেশনের আওতাভূক্ত করা হয়েছে। বাদ পড়ে গেছে ইউনিয়নের ৬টি মৌজা। এই ৬ মৌজাকেও সিসিকের অর্ন্তভূক্ত করার দাবিতে গত ৩০ আগস্ট জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

এসব এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, গণবিজ্ঞপ্তিতে ইউনিয়ন বিভক্ত করা হয়েছে। তাদের মতে, একটি ইউনিয়নের অর্ধেক বা কিছু অংশ সিটিতে অন্তর্ভুক্ত করলে স্থানীয়দের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। পাশাপাশি থাকার পরও সিটি ও ইউনিয়নের সেবা আলাদা হওয়ায় অনেকেই বৈষম্যের শিকার হবেন। তাই কোনো ইউনিয়নকে আংশিকভাবে সিটিতে অন্তর্ভুক্ত না করে পুরো ইউনিয়নকে সিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তারা।

গত ৩ সেপ্টেম্বর সিলেট দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের ৬টি মৌজা সিলেট সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্তির দাবীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সিলেট সিটি মেয়র, ও সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারক লিপি প্রদান করেছে এলাকাবাসী। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, কুচাই ইউনিয়নের পালপুর, কুচাই, পশ্চিমভাগ, শ্রীরামপুর, সুলতানপুর ও তৈয়বসুলতান মৌজাকে বাদ দিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের সীমানা বৃদ্ধির খসড়া গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা চাই পালপুর, কুচাই, পশ্চিমভাগ, শ্রীরামপুর,সুলতানপুর ও তৈয়বসুলতান মৌজাকেও সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

বিজ্ঞাপন



কুচাই গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সামরান সাবের বলেন, কুচাই ইউনিয়ন আগে কদমতলী পর্যন্ত ছিল। সিটি করপোরেশন গঠন করার সময় এই ইউনিয়নের কিছু অংশ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এই ইউনিয়ন টুকরো হয়ে গেছে। এখন আবারো সিটি করপোরেশন এলাকা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আবারো এই ইউনিয়নয় টুকরো হবে। তাই আমরা চাই পুরো কুচাই ইউনিয়নকে যেন সিসিকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ এভাবে ধাপে ধাপে ইউনিয়নকে টুকরো করা হলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আঙ্গিনার একপাশে আমার বাড়ি সিসিকের অংশে পরেছে কিন্তু আঙ্গিনার অপর পাশে আমার আত্মীয় বা ভাইয়ের বাড়ি ইউনিয়নে পড়েছে। সিসিকের আয়তন বৃদ্ধি করলে এই সমস্যাটায় বেশি সম্মুখীন হতে হবে এলাকাবাসীকে। তাছাড়া উন্নয়ন এবং সেবা বৈষম্যতো আছেই। কারণ আমরা সবাই জানি সিসিকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে এলাকার উন্নয়ন ও সেবা বৃদ্ধি পাবে। তাই সবারই আশা সিসিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার।
    
গত ৩১ আগস্ট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা সিসিকের অন্তর্ভুক্ত না হতে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন জানান। আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, খাদিমপাড়া ইউনিয়নের যে সব এলাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় আনা হয়েছে সেসব এলাকার বেশীর ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাই উক্ত এলাকা সিটিতে অন্তর্ভুক্তি থেকে যদি সম্ভব হয় তাহলে বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আজাদুর রহমান সামাদ বলেন, সিটি করপোরেশন বৃদ্ধিকরণের যে সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে সেটা সঠিক। তবে আমাদের ইউনিয়নের যে সকল এলাকা সিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। তাই এসব এলাকা সিটিতে অন্তর্ভুক্তি থেকে বাদ দিতে পারলে ভাল হয়। তারপরও যদি নিতে হয় তাহলে যেন পুরো ইউনিয়নকে সিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তা না হলে এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

জানা যায়, ২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা থেকে উন্নীত হয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনে রূপলাভ করে। প্রথমধাপে ২৬.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে যাত্রা শুরু করে সিলেট সিটি করপোরেশন। গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত এলাকাগুলো যুক্ত হলে সিসিকের আয়তন বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫৮ বর্গকিলোমিটার।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিসিকে অন্তর্ভুক্ত হতে অনেকেই আবেদন করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কিন্তু সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের করার কিছু নেই। নিয়মানুযায়ী জেলা প্রশাসন সীমানা চিহ্নিত করবে। জেলা প্রশাসনের কাছে গণশুনানী হবে। সেই শুনানির ভিত্তিতে কোন কোন জায়গা সিটির ভিতরে পরবে তার সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসন নিবে। সীমানা চিহ্নিত করে যখন আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে তখন আমরা এর দায়িত্ব পাবো। এর আগে পর্যন্ত সরকার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

তিনি বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের সব থেকে ছোট সিটি করপোরেশন। একটি বিভাগীয় শহরের সিটি করপোরেশন মাত্র ২৬ বর্গ কিলোমিটার। যেখানে অন্য এলাকার সিটি করপোরেশন ৮০ থেকে ১০০ বর্গকিলোমিটার হয়। ছোট হওয়ার ফলে কেন্দ্র থেকে বরাদ্দ কম আসে। আর নাগরিক সেবা ভালো ভাবে পেতে গেলে সিটি করপোরেশন বড় করা এখন সময়ের দাবি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিলেটের উপ-পরিচালক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, সিটি করপোরেশন বৃদ্ধিকরণ নিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকলে সে বিষয়ে আবেদন করার জন্য বলা হয়েছে। স্থানীয়রা বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্মারকলিপি দিচ্ছেন। তাদের দাবি মানা হবে কি হবে না এ বিষয়ে এখন কিছু বলা যাবে না। যারা আবেদন করেছেন তাদের আবেদনের শুনানি হবে। তারপর সিসিকের আয়তন বৃদ্ধির ব্যপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারী হবে।

এ প্রসঙ্গে গত ১৯ আগস্ট সিটি করপোরেশনে একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, আপাপতত সিটিকে দিগুণ করা হয়েছে। তবে আরও অনেক ইউনিয়ন আছে যারা সিটি করপোরেশনের সাথে যুক্ত হতে চায়। তারা তাদের দাবি তুলুক। আগামীতে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত