নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:৫০

আমি একা কত করব?

ধর্ষণের ঘটনা ও পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ

সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে। ধর্ষকদের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার সবাই। একইসঙ্গে কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায় কীভাবে ছাত্রাবাস খোলা থাকে ও ছাত্রাবাসে এরকম নৃশংস ঘটনা ঘটে এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে।

দায়িত্বে ব্যর্থতা ও ছাত্রলীগ তোষণের অভিযোগ ওঠেছে কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক সালেহ আহমদের বিরুদ্ধে। তার পদত্যাগেরও দাবি ওঠেছে। খোদ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ অধ্যক্ষকে অদক্ষ দাবি করে তার পদত্যাগের দাবি করেছে। তবে পদত্যাগের দাবিকে তেমন আমলে নিচ্ছেন না অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে রাতে। দিনেরবেলা ঘটেনি। এসময় সময় আমি বাসাতে থাকি। তখন তো আর অফিসে থাকি না। তবে বাসায় থাকলেও ২৪ ঘণ্টাই আমি দায়িত্ব পালনের মধ্যেই থাকি। হোস্টেল সুপার কিংবা কর্মচারীরা আমাকে কোনো বিষয়ে জানালে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাই। কিন্তু আমাকে যদি নিরাপত্তাকর্মীরা ইনফর্ম না করেন তাহলে খবর পাব কীভাবে? আসলে ওইসময় নিরাপত্তাকর্মীরা ওখানে ছিলেন না। বিষয়টি আমাকে পুলিশ জানিয়েছে। এরপর আমি তাদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই। বিষয়টি র‌্যাবকেও অবহিত করি।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত কলেজ বন্ধ আছে। যদিও ছাত্রাবাস বন্ধ, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী টিউশনি করত, মানবিক কারণে তাই হোস্টেলে ২৫ জনকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। এখন এ ঘটনার পর সবাইকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। অলরেডি সবাই চলেও গেছে। কলেজ বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন আমি ক্যাম্পাসে এসেছি, অফিস করেছি। আমি অন্যান্য সহকর্মীদের বলেছি, আপনার অনলাইনে ক্লাস নিন, তবে মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে আসেন, খোঁজখবর নেন। এখন বলেন- এত বড় একটি ক্যাম্পাস, এই করোনাপরিস্থিতিতে একা আমার পক্ষে দেখভাল করা সম্ভব? আমি একা কত করব? উপাধ্যক্ষ একা কত করবেন? অনেক কষ্ট আছে, দায়িত্বে বসে সবকিছু তো আর বলা যায় না।

ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত যে ঘটনা ছাত্রাবাস চত্বরের ভেতরে ঘটেছে, এটাতো আকস্মিক ঘটেছে। কিন্তু পুরো বিষয়টিতে আমরা লজ্জিত। শুধু একজন অধ্যক্ষ হিসেবে নয়, একজন বাবা হিসেবে আমি বলতে চাই, এই তরুণীর পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। এই ভিকটিমের পরিবারের এখন সাপোর্ট দরকার।

বিজ্ঞাপন


 
এই মামলার আসামিরা ধরা না পড়লে প্রশ্ন থেকে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্রুততার সঙ্গে দোষীদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এদের ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এরপর বিচার করতে হবে, বিচারে আস্থা আনতে হবে। বিচারহীনতার যে বিষয়টা, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি যে সহিংসতা, এটা তো সর্বত্র চলছে। আমার প্রতিষ্ঠানেও এমনটা ঘটল। এখন, এরা (গণধর্ষণকারীরা) যদি ছাত্রাবাসে না গিয়ে অন্য জায়গায় যেত, তাহলেও তো ঘটনার ভয়াবহতা একই রকমেরই থাকত। এখন, আমার ছাত্রাবাসের গেটটা খোলা পেয়েছে, গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছে। হোস্টেলের ভেতরের রাস্তায় অন্ধকার ছিল, সেই সুযোগটা ওরা নিয়েছে। এখনো সবাই ধরা পড়েনি। নিশ্চয়ই একদিনের ব্যবধানে ওরা দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। ওদের ছবি এখন ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রত্যেক দোষী গ্রেপ্তার হোক, এটাই এখন চাই।

কলেজে ও ছাত্রাবাসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ছাত্রলীগের নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রসঙ্গে সালেহ আহমদ বলেন, আমি তো সব কথা বলতে পারি না। আমার মুখে তালা লাগিয়ে থাকতে হয়। অনেক কিছু আছে আমরা বলতে পারি না। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বলতে পারি না। ২০১২ সালে হোস্টেল পুড়িয়ে দেওয়ার পর ৬ কোটি টাকা খরচ করে নতুন ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পোড়ানোর ঘটনার বিচার তো হয়নি। সেদিন ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। কারা ছাত্রাবাস পুড়িয়েছিল, সেটা প্রমাণের বিষয়, এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তবে যারাই ছাত্রাবাস জ্বালিয়েছে, তাদের বিচার তো হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক। তখন অন্যরা বুঝতে পারবে, দোষ করলে বিচার হবে। তবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে এখন এ-সংক্রান্ত কেসটা আছে।

বিজ্ঞাপন



ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বেপোরায়া আচরণ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে সবাই ছাত্র, এটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। একজন দোষী ও অপরাধী ব্যক্তিকে তার অপকর্মের দায় নিজেকেই নিতে হবে। যখনই ক্যাম্পাসে ছিনতাই কিংবা অন্য কোনো অপকর্মের অভিযোগ পেয়েছি, তখনই ব্যবস্থা নিয়েছি, নিচ্ছি। আবার এটাও ঠিক, অনেকে সন্ধ্যার পর নীরব হয়ে যাওয়া কলেজে অবস্থান করেন। সেখানেও দর্শনার্থীদের সচেতন হতে হবে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে পারেন যে কেউ, কিন্তু সন্ধ্যার পর এখানে থাকা ঠিক নয়। যারা বেড়াতে আসেন, তাদের অনেককেই দেখি ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে কলেজের পার্শ্ববর্তী টিলাতেও যান। এটাও তো ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বিষয়েও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কলেজ এলাকায় পুলিশি টহল আরও বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাব।

ধর্ষণের ঘটনার পর দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা নিয়েও ফেসবুকে সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ওরা নিরীহ মানুষ, ওদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তাহলে কেন তাদের বরখাস্ত করা হলো। দেখুন, মানবিকতা দেখালেও সমস্যা, না দেখালেও সমস্যা। আসলে তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলা পেয়েছি বলেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন, গত শুক্রবার যে ঘটনা ঘটল, সেটা তো তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে ছাত্রাবাসের দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের জানানোর কথা ছিল। কিন্তু তারা তা জানায়নি। জানতে পেরেছি, ওরা নাকি তখন ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আবার অনেকে বলছেন, তারা (নিরাপত্তাকর্মী) থাকলেই কী করতেন? তারা তো তাদের (গণধর্ষণকারী) আটকাতে পারত না। সেটা ঠিক তারা আটকাতে পারতেন না, কিন্তু আমাদের ইনফর্ম তো করতে পারতেন।

বিজ্ঞাপন



অধ্যক্ষ বলেন, তরুণীর স্বামী থানায় যে মামলা করেছেন, সেখানে ছয়জনের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে একজনের ছাত্রাবাসে সিট বরাদ্দ ছিল। যেহেতু তার নামে অভিযোগ এসেছে, তাই সাময়িকভাবে তার সিট বাতিল করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার সিট চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে এবং তার ছাত্রত্ব বাতিলের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা হবে। মামলার তিনজন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বাকি দুজন বহিরাগত। সার্বিক বিষয়ে তদন্ত চলছে। তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে গতকাল শনিবার। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত