নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ জানুয়ারি, ২০২১ ১৯:৩৭

শ্যামাচরণ হত্যা : সাংসদ রতনের বিচার দাবি

ধর্মপাশায় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নেতা শ্যামাচরণ বর্মণ হত্যার জন্য সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে দায়ী করে তার বিচার দাবি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) সিলেট নগরে আয়োজিত 'সংক্ষুব্দ নাগরিকবন্ধন' কর্মসূচী থেকে এ দাবি জানানো হয়। এসময় শ্যামচরণ হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করা হয়।

'সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন' নামের একটি নাগরিক সংগঠন বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করে।

এই কর্মসূচীতে বক্তরা বলেন, সাংসদ রতন হাওর অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখানকার অতীত গৌরবময় রাজনীতির মুখে চুনকালি দিয়ে লুটপাট, চাঁদাবাজী, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাদক ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ, জলমহাল ও বালুমহাল থেকে অর্থ আদায়ে এসে ঠেকেছে সুনামগঞ্জের রাজনীতি। এই সাংসদের বিরুদ্ধে বাড়ি দখল, জায়গা দখলের অভিযোগতো আছেই মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিবাদী দলীয় নেতাকর্মীদের হেনস্থা করার অসংখ্য অভিযোগ আছে। নিজের ভাইকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করানো সহ মধ্যনগর-ধর্মপাশা এলাকাতে পরিবারতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। তাই সেখানকার প্রশাসন সাংসদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। সেখানে তার কথাই আইন। তার অবৈধ অর্থের কাছে আইনের শাসন আজ পদদলিত।

নাগরিকবন্ধনে মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী ছাড়াও সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মৎসজীবী শ্যামচরণ বর্মনের ছেলে ও ভাই বক্তব্য রাখেন।

এতে নিহত শ্যামাচরণ বর্মণের ছেলে চন্দন বর্মণ ও ভাই মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মন উপস্থিত হয়ে সন্ত্রাস কবলিত হাওরপাড়ের চিত্র তুলে ধরেন।

মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ বর্মণ রানা-এর সভাপতিত্বে ও 'সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন'-এর সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিমের সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সিলেট মহানগর সভাপতি এডভোকেট মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা, সম্মিলিত নাট্যপরিষদ সিলেট-এর সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সজল ছত্রী, সাংস্কৃতিক সংগঠক এনামুল মুনির, গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু প্রমুখ।

এতে আরো অংশগ্রহণ করেন চিত্রশিল্পী সত্যজিত রাজন, মেঠোসুর সম্পাদক বিমান তালুকদার, দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা'র সংগঠক রাজিব রাসেল ও নিরঞ্জন সরকার অপু, হাওরপারের ধামাইল-এর সহ-সভাপতি সজল কান্তি সরকার , সুনামগঞ্জের সাবেক ছাত্রনেতা পরিতোষ ঘোষ চৌধুরী, ছাত্রমৈত্রী সিলেট জেলা শাখার সভাপতি মাসুদ রানা চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সংগঠক রুবেল মিয়া প্রমুখ।

বক্তারা আরও বলেন, কালো টাকার প্রভাবে হাওর এলাকাকে নরক বানিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ মুখ খুললেই তাকে গুম বা হত্যা করা হচ্ছে। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছে খোদ এলাকার সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও তার ভাই ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জামেল হোসেন রোকন। রোকনের নেতৃত্বেই গত ৭ জানুয়ারি সুনই নদীর জলমহালে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং মৱসজীবী সমিতির সভাপতির বাবাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মামলা নিচ্ছে না পুলিশ।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন-এর সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম সূচনা বক্তব্যে বলেন, ধর্মপাশায় সুনাই নদীর তীরে সেদিন যা হয়েছে, তা মানবতা বিরোধী অপরাধ। রাতের আঁধারে একটি জনগোষ্ঠির জীবন জীবিকার উৎসে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও জবাই করে একজন বৃদ্ধলোককে হত্যা করার পরেও স্থানীয় প্রশাসনের নির্লজ্জ আচরণে আমরা সংক্ষুব্ধ। হাওর অঞ্চলে সাংসদ রতন ও তার ভাই-অনুসারীদের নেতৃত্বে যা চলছে তা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। তি

নি ক্ষোভের সাথে বলেন, এক মাস পুর্বে এই সমিতি ঢাকা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চেয়েছিল। স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল কিন্তু তাদের কথা কেউ কানে তোলেনি। বরঞ্চ ঢাকাতে প্রেস কনফারেন্স করায় সাংসদ রতনের ভাইদের অত্যাচার আরো বেড়ে যায়।

শ্যামচরণের ছেলে চন্দন বর্মণ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, গত ৭ জানুয়ারী রাতে সুনই জলমহালে স্থানীয় সংসদ সদস্যের আপন তিন ভাইয়ের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। এ সময় জলমহালে মৎস্যজীবীদের খলা (জেলেদের থাকার জন্য তৈরি স্থাপনা) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার বাবা ৬৫ বছর বয়সের শ্যামাচরণ বর্মণের গলা কেটে হত্যা করা হয়। সাংসদ বাহিনীর হামলায় সমিতির কমপক্ষে ২০ জন সদস্য আহত হয়।

তিনি বলেন, এই হামলা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। সাংসদ ইতিপূর্বে আমাদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ধর্মপাশা থানায় আমার বাবা হত্যায় মামলা দায়ের করতে চেয়েছিলাম। সেই মামলায় মোট ৬৩ জনকে আসামী ও ২১ জনকে সাক্ষ্মী করেছি। ১ নং আসামী করেছি সাংসদ রতনকে। কারন সেই এই হামলার ও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। অথচ অভিযোগপত্রে সাংসদের নাম থাকায় ধর্মপাশা থানা মামলা নেয়নি।

নিহত শ্যমাচরণ বর্মণের ভাই মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, মনাই নদী প্রকাশিত সুনই নদী জলমহাল ১৪২২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৪২৭ বঙ্গাব্ধ পর্যন্ত সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ইজারা লাভ করেছে। ২০১৮ সালে এ সমিতিকে মৎস্য আহরণের জন্য জাতীয় পদক পর্যন্ত প্রদান দেয়া হয়। কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ এলাকায় সাংসদ রতন ও তার তিন ভাইকে শরিকানা না দিয়ে কোন কিছুই করা যায় না। তাই মৎস্য আহরণে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত এ সমিতির ইজারার দিকে নজর পড়ে সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের। সাংসদ রতন এই সমবায় সমিতিকে ইজারা বহাল রাখতে হলে তাকে অংশীদার করার কথা বলেন। সমিতি নিরুপায় হয়ে সাংসদকে বছরে দশ লক্ষ টাকা করে চাঁদা দিতে থাকে। এতেও সাংসদকে তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি। সাংসদ ইজারার ছয় আনা অংশীদারিত্ব তাকে প্রদান করতে জোরজবরদস্তি করলে সমবায় সমিতি এতে অসম্মতি জানায়। ফলে সমিতির উপর নেমে আসে নানান অত্যাচার নির্যাতন।

মনীন্দ্র বর্মণ আরো বলেন, গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই হামলার আশংকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে আমরা বলেছিলাম, সাংসদের অত্যাচারে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আজ নিরুপায় হয়ে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে এসেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের বাঁচান।

সভাপতির বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ বর্মণ রানা বলেন, ক্ষমতায় যখন অসাম্প্রদায়িক সরকার ঠিক সেই সময়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের নারকীয় অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতেই এখানে পবিত্র শহিদ মিনারের সম্মুখে দাঁড়িয়েছি। দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে যার লাগামহীন অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য প্রমান রয়েছে সেই মোয়াজ্জেম হোসেন রতন কিভাবে এই সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের ভারতে পাঠানোর মত ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলে। রতনের ভিডিও আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। নিজের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে জলমহালে হামলা করে মানুষ হত্যার পর সে আবার সমবেদনা জানাতে ওসি সাহেবকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। ওসি সাহেবের উচিত ছিল হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত সাংসদের ভাইকে গ্রেপ্তার করা। তিনি তা না করে সাংসদের প্রটোকল দিচ্ছিলেন। এই হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দরকার। সাংসদ রতনের মত ব্যাক্তিকে আমাদের পবিত্র সংসদে রাখাটা সংসদের অপমান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত