নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ১৮:৫৮

তাদের জীবনে এরচেয়ে আনন্দের দিন আর আসেনি

পিয়ারা বেগমের চোখে জল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন তো নাক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। এমন অবস্থায়ও তার ঠোঁটের কোণে হাসি। উদ্বাস্তু জীবন আর নিজের কষ্টের অতীতের স্মৃতিচারণ করে কাঁদেন পিয়ারা। আবার পরক্ষণেই নিজস্ব একটি বাড়ির মালিকানার গর্বে হেসে ওঠেন।

শনিবার শীতের কুয়াশাস্নাত সকালে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়নে পিয়ারার বেদনা-আনন্দ-প্রাপ্তি সব একাকার হয়ে ওঠে। এদিন এই উপজেলার ১৭ ভূমিহীনদের মাঝে সরকারি উদোগে নির্মিত ঘরের দলিল হস্তান্তর করা হয়।

ঘর পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে পিয়ারা বেগমও রয়েছে। সেই ঘরের দলিল নিতেই শনিবার উপজেলা পরিষদ ভবনে এসেছিলেন পিয়ারা। সেখানেই দেখা মিলে তার এমন হাসিকান্নার যুগলবন্দির।

চোখের জল মুছতেই মুছতেই বলেন, আজ আমার বড় খুশির দিন বাবা। আল্লাহ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাইছইন। নবীজী আমার বাগানো ফুল ফুটাইছইন।

এটুকু বলেই আবার চোখ-নাক মুছেন পিয়ারা। বলেন, আফনেরা হকলরে আমার ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রীরে আমার ধন্যবাদ। নিজোর একটা ঘর অইবো জীবনে কুনোদিন ভাবছি না।  যারা ইটা করছইন তারা আখেরোতোর কাম করছইন। এইটুকু বলে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন পিয়ারা।

কান্না একটু থামলে জানা যায় তার অতীত। পিয়ারা বেগমের জীবনটা কেটেছে বড় কষ্টে। ৩ মেয়ে আর ছেলের জন্মের পরই মারা যান দিনমজুর স্বামী। দুই মেয়ে আর ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা এখন আলাদা থাকেন।  ছেলেও মায়ের খোঁজ রাখেন না। পিয়ারার সাথে থাকেন কেবল তার ছোট মেয়ে। যিনি শারিরীক প্রতিবন্ধি। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেন পিয়ারা। বাবার বাড়ি ছিলো সিলেট নগরের কানিশাইলে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে বিভিন্নজনের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থেকছেন। অনেক সময় আশ্রয়দাতারা বের করেও দিয়েছেন। এরপর নতুন আশ্রয় পাওয়ায় আগে প্রতিবন্ধি মেয়েকে নিয়ে সিলেটের শাহজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) মাজারেও অনেকবার থাকতে হয়েছে তাকে। সেই পিয়ারা বেগমও নিজের একটি ঘর পেয়েছেন।
 
সদর উপজেলায় ঘরের দলিল নিতে এসেছিলেন শাহজাহানও। অটোরিকশা চালক শাহজাহানের নিজের কোনো ঘর নেই। জায়গা জমি যা ছিলো তা বাবা বিক্রি করে দিয়েছেন। শাহজাহান থাকেন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের জাঙ্গাইলে শ্বশুর বাড়িতে। পরিবার নিয়ে শ্বশুড়বাড়িতে থাকা নিয়ে লজ্জ্বা ছিলো শাহজাহানের। তার সেই লজ্জ্বার দিন এবার ঘুচেছে।

শাহজাহানের ভাষায়, শ্বশুড় বাড়িতে থাকার মতো শরমের আর কিছু নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমারে সেই শরম থেকে উদ্ধার করেছেন। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা তার উন্নতি কামনা করি।

ঘর পেয়েছেন আব্দুল বাতিনও। কিন্তু ঘরের দলিল নিতে আসতে পারেননি তিনি। স্ট্রোক করে মাসখানেক ধরে একেবারে বিছনাবন্দি বাতিন। বাতিনের পক্ষে তার বৃদ্ধ বাবা আছির আলী নিয়ে যান বাড়ির দলিল।

আছিল আলী বলেন, আমাদের পরিবারে আমার ছেলেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অথচ সে দুই মাস ধরে বিছনায়। আমরা বুড়ো-বুড়ি, ছেলে, ছেলে বউ আর এক নাতি নিয়ে সংসার। সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাওয়ে একজনের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় থাকি। এখন অন্তত এই আশ্রিতের জীবন কাটবে। নিজেরে একটা বাড়ি হবে। এরচেয়ে আনন্দের দিন আমার জীবনে আর আসেনি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ প্রকল্পে সিলেট সদর উপজেলায় ১৪৪ জন গৃহহীন নিজস্ব ঘর পাচ্ছেন। তবে এ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ১৭টির। শনিবার সকালে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই ১৭টি ঘরের দলিল হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন।

খাদিমপাড়া, খাদিমনগর ও কান্দিগাও এই ৩ ইউনিয়নে নির্মিত ১৭টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মমতাজ মহুয়া। বাকীঘরগুলোও দ্রুত নির্মাণ কাজ শেষ করে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তিনি।

তবে হস্তান্তর করা ঘরগুলোতেও এখন পর্যন্ত কেউ উঠেননি। আনুসাঙ্গিক কিছু কাজ শেষে দুএকদিনের মধ্যে সবাউ উঠবেন বলে জানিয়েছেন। খাদিমপাড়ায় ঘর পেয়েছেন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ঘরের টুকটাক কিছু কাজ বাকী রয়েছে। এসব কাজ শেষে কাল থেকে মালপত্র তোলা শুরু করবো। দুএকদিন পর নতুন বাড়িতে উঠবো।

মনোয়ারা বেগমের স্বামী রিকশা চালান। যে জায়গায় ঘর বরাদ্ধ পেয়েছেন তার ঠিক পাশেই খাস জমিতে বাঁশ-বেত দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করে থাকতেন তারা।
 
মনোয়ারা বেগম বলেন, খাস জমিতে থাকায় সবসময় উচ্ছেদের ভয়ে থাকতাম। এখন সেই ভয় আর নেই। এবার নিজের একটি বাড়ি হলো।

ঘর পাওয়ার জন্য কাউকে কোনো টাকা দিতে হয়নি বা সুপারিশ করতে হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, একদিন হঠাৎ আমার বাড়িতে এসে চেয়ারম্যান সাহেব ও একজন ম্যাডাম বলেন, 'তোমাকে ঘর তৈরি করে দেবে সরকার'। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে দেখি সত্যি সত্যি ঘর তৈরি হচ্ছে।

খাদিমনগর ইউনিয়নের ফেরদুস আহমদও ঘর পেয়েছেন। তার আরেকটু আবদার আছে। ফেরদুস বলেন, আমার দুটি গরু আছে। গরুগুলো রাখার জন্য পাকা ঘরের পাশে খালি জায়গায় একটি কাচা ঘর নির্মাণ করতে চাই। আপনি আমার জন্য সরকারের কাছে একটু তদবির করবেন।

রিকশাচালক ফেরদুস বলেন, আমার দুটি মেয়ে আছে। কেবল রিকশা চালিয়ে তো মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। তাই গরু রেখেছি। এখন এগুলো পালনের সুযোগ চাই।

সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিলেটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সিলেট ৪১৭৮টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার ঘর নির্মণ শেষে শনিবার হস্তান্তর করা হয়েছে। এই ঘরগুলোর প্রতিটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। প্রতিটি ঘরে দুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম রাখা হয়েছে।

সিলেট জেলার মধ্যে সিলেট সদরে ১৪৪টি, দক্ষিণ সুরমায় ১২০টি, বিশ^নাথে ৬৬৯টি, ওসমানীনগরে ৫৩৩টি, বালাগঞ্জে ৮৭৫টি, বিয়ানীবাজারে ১০৪টি, গোলাপগঞ্জে ২০০টি, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৩০টি, গোয়াইনঘাটে ৫০০টি, কানাইঘাটে ১৯৩টি, জৈন্তাপুরে ৩৩০টি, জকিগঞ্জে ১৩০টি এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৫০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে বেশিরভাগের এখনও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। প্রায় দেড় হাজার ঘরের কাজ শেষে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ঘরগুলোতে এখনও কেউ উঠেননি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রথমে ঘরহীন ও ভূমিহীনদের তালিকা করা হয়। সে তালিকা যাচাইবাছাই করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়। যাচাইবাছাই শেষে প্রকৃত ভূমিহীন ও ঘরহীনদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসলাম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুজিববর্ষে ভূমিহীনদের ঘরসহ ভূমি উপহার দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারি জায়গায় গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ২ শতক ভূমিতে প্রতিটি টিনশেডের আধাপাকা ঘর নির্মাণে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে।

সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ফজলুল কবীর জানিয়েছেন, মুজিববর্ষে সিলেট বিভাগে ৯ হাজার ৯৪৮টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সিলেট জেলার ৪ হাজার ১৭৮টি পরিবার ঘর পাবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত