নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০৯:১৯

একটি শিশুই নাড়িয়ে দিলো দেশ

সিলেটের সদর উপজেলার বাদেআলী গ্রামের ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজন। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। আলাভোলা। তাই লেখাপড়ার ছেড়ে মায়ের সাথে সবজি চাষ এবং তা বাজারে বিক্রি করেই নিত্য অভাবের সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতো রাজন।

এই গ্রামীণ, নীরিহ, গরিব শিশুটিই জাগিয়ে তুললো পুরো দেশ। জাগিয়ে তুললো পুরো দেশের বিবেক। পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো এই শিশুর জন্য। মানুষ দাবি জানালো ন্যায় বিচারের এবং গ্রুত বিচারের। এমনকি জনতা উদ্যোগী হয়েই আসামীদের তুলে দিলো পুলিশের হাতে।

ঘটনার সূত্রপাত গত ৮ জুলাই। এই সকালেও অন্যান্যদিনের মতো সবজি বিক্রি করতে কুমারগাও আসে রাজন। কুমারগাওয়ে একটি গাড়ি মেরামতখানায় চুরির অপবাদে রাজনকে আটকে রেখে মারধর শুরু করে এই মেরামতখানার চৌকিদার ময়না। (যদি আদালতে সাক্ষীরা জানিয়েছেন, বলাৎকারে ব্যর্থ হয়েই রাজনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদ তুলে ময়না।)

এরপর সেই মারধরে এসে শরিক হয় এই গাড়ি মেরামতখানার মালিক মুহিত হােসেন, তার ভাই সদ্য সৌদি ফেরত কামরুল ইসলামসহ অন্য ভাইয়েরা এবং আশপাশের আরো কয়েকজন। বিকৃত-বিভৎস নির্যাতন চালানো হয় রাজনের উপর। এই নির্যাতনের ভিডিওচিত্রও ধারণ করে ঘাতকরা।

নির্যাতন সহ্য করে না পেরে একপর্যায়ে মারা যায় শিশু রাজন। মৃত্যুর আগে পানি খেতে চেয়েছিলো রাজন। তাকে ঘাম খেতে বলে ঘাতকরা। রাজন মারা যাওয়ার পর মাইক্রোবাসযোগে লাশ গুম করতে নিয়ে যায় মুহিত। কুমারগাও এলাকাবাসীর এতে সন্দেহ হলে তারা মাইক্রোবাসটি আটক করে দেখতে পান ভেতরে একটি মরদেহ। সাথেসাথে তারা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে ও মুহিত আলমকে আটক করে নিয়ে যায়।

ওই রাতেই জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে 'চুরির দায়ে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতনামা এ ব্যক্তির মৃত্যুর' ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। রাতে ছেলের লাশ সনাক্ত করে থানায় মামলা করতে আসেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান। তার সাথে দুর্ব্যবহার করে থানা পুলিশ। তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ তখন ঘাতকদের সাথে আপোষরফায় ব্যস্ত।

পরদিন বাদেআলী গ্রামের লোকজন জালালাবাদ থানা ঘেরাও করে। সেদিন রাজনের বাবাকেও দেওয়া হয় আপোস প্রস্তাব। এইদিনই পুলিশের সাথে দফারফা করে সৌদি আরব পালিয়ে যায় প্রধান অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম।

তবে তখন পর্যন্ত পুলিশ, ঘাতকেরা, রাজনের গ্রামের লোকজন আর সংশ্লিষ্ট দু'একজন ছাড়া তেমন কেউ জানতো না ঘটনাটা। মিডিয়ায় গুরুত্বহীনভাবে এসেছে লাশ উদ্ধার আর মামলা দায়েরের খবর।

১০ জুলাই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে রাজনকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র। ১১ জুলাই থেকে সকল মিডিয়ার প্রধান খবরে পরিণত হয় এই ভিডিওচিত্র। এরপর তো ইতিহাস। সারাদেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। টনক নড়ে প্রশাসনের। সরকারের বড় বড় মন্ত্রীরা এসে ভীড় করতে থাকেন রাজনের বাড়িতে। আসে বিভিন্ন মহল থেকে অর্থ সাহায্য। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলতে থাকে দেশের বাইরেও।

দেশজুড়ে সৃষ্ট আলোড়নের ফলে যে রাজনের বাবাকে কয়দিন আগেই থানা থেকে গালি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাকেই দেওয়া হয় সার্বক্ষণিক পুলিশী নিরাপত্তা। মামলার বাদিসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়।

একে একে ধরা পড়তে থাকে রাজন হত্যার আসামীরা। জনতা পুলিশের হাতে তুলে দিতে থাকে আসামীদের। স্থানীয় এলাকাবাসী ১০ জন আসামীকে আটক করে পুলিশে দেন। এমনকি ১২ জুলাই সৌদি প্রবাসী বাঙালিরা কামরুল ইসলামকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বিচার কাজও চলতে থাকে দ্রুত। অবশেষে হত্যার মাত্র ৪ মাসের মধ্যে আজ দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মামলার রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে। সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা আলোচিত এই মামলাটির রায় ঘোষণা করবেন।

গত ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে এই হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১০ দিনে মামলায় ৩৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরবর্তী প্রধান আসামী কামরুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে আরো ১ দিনে ১১ জন স্বাক্ষীর পুনরায় স্বাক্ষ্যগ্রহণ হয়। পরে টানা তিন কার্যদিবসের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয় ২৭ অক্টোবর।

উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা ৮ নভেম্বর মামলাটির চূড়ান্ত রায় প্রদানের তারিখ ঘোষণা করেন। হত্যাকাণ্ডের চার মাস এবং চার্জ গঠনের ৩৬ দিনের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এই মামলাল বিচার কাজ শেষ হয়।

গত ১৫ অক্টোবর কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার। মামলার ১৩ আসামীর মধ্যে কামরুলসহ ১১ জন কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন শামীম ও পাভেল নামের দু'জন।

১৬ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২৪ আগষ্ট আসামীদের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেয় আদালত। ২৫ আগষ্ট মালামাল ক্রোক করে পুলিশ। ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরের আদেশ হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত