নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ নভেম্বর, ২০১৫ ১৯:২০

অনন্ত বিজয় হত্যা: ছয় মাসেও তৈরি হয়নি অভিযোগপত্র

ছেলের মরদেহের সামনে অনন্ত বিজয় দাশের মায়ের আহাজারি (ফাইল ছবি)

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে আজ। অথচ ছয় মাসেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করতে পারেনি পুলিশ।

মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর কর্মকর্তারা জানান, অনন্ত হত্যার রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন তারা। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আরো দু'জনকে তারা খুঁজছেন।

অচিরেই এই দু'জনকে গ্রেফতার সম্ভব হবে জানিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এদের গ্রেফতার সম্ভব হলেই অভিযোগপত্র প্রদান করা হবে।

সিআইডি সূত্রে জানা যায়, অনন্ত বিজয় হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯ জন ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার আসামী। তাদেরকে এই মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। আর ৪ জনকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিজিৎ ও অনন্ত দু'জনই মুক্তমনা ব্লগে লেখালেখি করতেন।

এই মামলায় সর্বপ্রথমে আটক ফটোসাংবাদিক ইদ্রিস আলী জামিনে রয়েছেন। আটক ১৩ আসামীর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট থেকে আটক মান্নান রাহি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে।



সর্বশেষ গত মঙ্গলবার শফিউর রহমান ফারাবী জুলহাস বিশ্বাস ও আবুল বাশারকে এই মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

গত সেপ্টেম্বরে র‌্যাব রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে আবুল বাশার, জুলহাস বিশ্বাস ও জাফরান আল হাসানকে আটক করে। এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা রহস্য উদঘাটিত হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করে সিআইডি পুলিশ।

তাদের দাবি মতে, হত্যার পরিকল্পনা হয় দেড় মাস আগে। বাড়িতে ও ব্যাংকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু সেসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বাসার সামনেই হত্যা করা হয় অনন্তকে। হত্যাকাণ্ডে ৫ জন অংশ নেয়। এদের মধ্যে মূলত ২ জন গ্রেফতার হয়েছে।

সেসময় সিআইডি পুলিশ জানায়, হত্যাকারীরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একই আদর্শে বিশ্বাসী। ২ জন কুপিয়ে অনন্তকে হত্যা করে। অপর ৩ জনের মধ্যে দুইজন ঘটনাস্থলে কেউ যাতে না আসতে পারে, সেই দায়িত্ব পালন করে। অপরজন মোবাইল ফোনে হত্যাকাণ্ডের পুরো দৃশ্য ভিডিও করে।

গত ১২ মে সকাল সাড়ে ৮টায় সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার নূরানী আবাসিক এলাকায় অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি সুবিদবাজারের বনকলাপাড়ার নূরানী এলাকার ১২/১৩ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। ঘটনাস্থল থেকে অনন্তর বাড়ি ৩০ থেকে ৪০ গজ দূরে।

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন অনন্ত বিজয়। এরপর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন পূবালী ব্যাংকে। সিলেটের জাউয়াবাজারে অবস্থিত পূবালী ব্যাংক শাখায় কর্মরত ছিলেন।

এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ১২ মে রাতেই অজ্ঞাত পরিচয় ৪ জনকে আসামি করে অনন্ত বিজয় দাশের বড়ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদী হয়ে সিলেট বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। প্রথমে পুলিশ তদন্ত করলেও পরে মামলাটির তদন্তভার সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগকে দেওয়া হয়। আনসার বাংলা ৮ নামের একটি সংগঠন এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, অনন্ত বিজয় হত্যায় প্রথম গ্রেফতার করা হয় স্থানীয় ফটোসাংবাদিক ইদ্রিস আলীকে। তার বাড়ি সিলেটের ফতেহপুর এলাকায়।

ইদ্রিস আলীর পর গত ২৭ আগস্ট সিলেট থেকে মান্নান ইয়াহিয়া (২৪) ও তার ভাই মোহাইমিন নোমানকে (২১) গ্রেফতার করে সিআইডি। দুই ভাই ইসলামী ছাত্র মজলিশের সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত সহোদর সিলেটের কানাইঘাটের পূর্বপালজুড় গ্রামের হাফিজ মইনউদ্দীনের ছেলে।

হত্যাকান্ডের আগে মান্নান ইয়াহিয়া নাম পরিবর্তন করে মান্নান রাহী এবং হত্যাকান্ডের পরে ইবনে মাইউন নামে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। মান্নান ইয়াহিয়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ভাই মোহাইমিন নোমান এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের ইসলামিক শিক্ষা বিভাগের ছাত্র।

সহোদরদের দেয়া তথ্যমতে, গত ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার সিআইডির হাতে হয় আবুল খায়ের (২২)। তার বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটে। তিনি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ছাত্র। তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সক্রিয় কর্মী।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

সিআইডি দাবি করেছে, মান্নানের জবানবন্দিতে বিজয় হত্যার বিষয়টি প্রায় পরিষ্কার হয়ে গেছে।

জবানবন্দি মতে, অনন্ত মুক্তমনা ব্লগে লেখালেখি করতেন। তার লেখালেখি বন্ধ করতে গ্রেফতারকৃত মান্নান রাহীর (প্রকৃত নাম মান্নান ইয়াহিয়া) সঙ্গে ফেসবুকে অনেক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অনিয়মিত ছাত্র এবং ছাত্র শিবিরের সাবেক সক্রিয় কর্মী শফিউর রহমান ফারাবীর।

সিআইডি সূত্র বলছে, দেড় মাস আগে অনন্তকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হত্যাকান্ডে অংশ নেয় ৫ জন। যদিও এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িত মান্নান রাহি ও আবুল খায়েরের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি সিআইডির।

মান্নানের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অনন্তকে দেড় মাস ধরেই হত্যার চেষ্টা চলছিল। হত্যাকারীরা পরস্পর বন্ধু। সবার বাড়িই সিলেটে। এর মধ্যে চারজনের বাড়িই সিলেটের কানাইঘাটে। অপরজনের বাড়ি সিলেট জেলার কানাইঘাটের পাশের একটি থানায়। হত্যাকারীরা সবাই ছাত্র। এদের মধ্যে একজন সিলেট শহরে অবস্থিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। বাকি চারজনই সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

হত্যাকারীরা অনন্তকে তার বাসায় ও ব্যাংকে এবং তার আশপাশে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু মিশন ব্যর্থ হয়। এরপর ব্যাংকে যাওয়ার পথেই অনন্তকে নূরানী পুকুরপাড়ে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন ২টি মোটরসাইকেলযোগে ৫ হত্যাকারী ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে একত্রে রওনা হয়। ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের কাছে কালো ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগেই ছিল হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাপাতি। মোটরসাইকেল ২টি ঘটনাস্থল থেকে ১০ থেকে ১২ গজ দূরে রাখা হয়। তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্ত পুকুরপাড়ে পৌঁছামাত্র ৫ জন তাকে ঘিরে ফেলে। চাপাতি দিয়ে মাথায় ও ঘাড়ে কুপিয়ে দুইজনে অনন্তকে হত্যা করে। বাকি তিনজন অনন্তকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে মাত্র ৫ থেকে ৬ গজ দূরে অবস্থান করতে থাকে। তারা সেখানে থাকা রাস্তার মুখে অবস্থান নেয়। যাতে কেউ অনন্তকে যেখানে কুপানো হচ্ছে, সেখানে যেতে না পারে। দুইজন চারদিকে সতর্ক নজর রাখে। একজন অনন্তকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। মাত্র কয়েক মিনিটেই কুপিয়ে অনন্তর মৃত্যু নিশ্চিত করার পর, তারা চাপাতি ব্যাগে ভরে সেই মোটরসাইকেলযোগেই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। যে দুইজন কুপিয়ে অনন্তকে হত্যা করে, তার মধ্যে আবুল খায়ের অন্যতম।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরমান আলী বলেন, হত্যাকান্ডে ৪ জন অংশ নিয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এদের মধ্যে দুজনকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেফতার করা হলেই এই মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত