নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ জুন, ২০২২ ১৮:৪০

‘তিন দিন ভাত খাইনি বাবা’

চারদিকে অথৈ জল, এর মধ্যেই গাছগাছালি ঘেরা কয়েকটি বাড়ি। দেখে মনে হয় যেন জলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়িগুলো। এর অনেকগুলোর ভেতরেও উঠেছে পানি। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রাউতার বিল এলাকার বাহাদুরপুর গ্রামের ওই বাড়িগুলোতে বসবাস কয়েকটি পরিবারের। বানের পানি ঘরে উঠলেও ঘর ছেড়ে যাননি অনেকে। পানি একটু কমায় কেউ কেউ আবার ফিরেছেন ঘরে।

হাওরের মাঝখানে পানিবন্দি হয়ে পড়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে পরিবারগুলো। নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন তারা। তিন দিন ভাত না খেয়ে থাকার কথাও জানালেন এক বৃদ্ধা।

বুধবার কোম্পানীগঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী শাহ আরেফিন টিলার পাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন মানুষ। পানিবন্দি থাকায় অনেকেই আবার আসতে পারছেন না। তারা ঘর থেকেই নৌকাকে উদ্দেশ করে হাঁক দিচ্ছেন। আবার অনেকে ঘরে থাকা ছোট নৌকা নিয়ে ঘিরে ধরছেন বড় নৌকায় করে আসা আগন্তুকদের। ত্রাণের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন তারা।

বাহাদুর গ্রামের বশির মিয়ার ঘরেও উঠেছে বানের পানি। তিনি বলেন, ‘সবাই কেবল মূল সড়কের আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। আমাদের দুর্গম এলাকায় কেউ আসতে চায় না। তাই আমরা খাবারের খুব সংকটে আছি। ছয় দিন ধরে পানিবন্দি। এর মধ্যে মাত্র এক দিন কিছু শুকনো খাবার পেয়েছি।’

পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ। তাই নৌকাই এখন ওই এলাকার একমাত্র বাহন। কোম্পানীগঞ্জের তেলিবাজার থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে এখন যেতে হয় বাহাদুরপুরে। এতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। একই গ্রামের আসকর আলীর নিজস্ব নৌকা আছে। তিনিও খাবার সংকটে আছেন বলে জানান। আসকর বলেন, ‘আমার ছোট নৌকা নিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে যাওয়া যায়। দূরের পথ পাড়ি দেয়া যায় না। এ ছাড়া হাওরের বড় বড় ঢেউয়ে ডুবে মরার ভয়ও আছে। তাই নৌকা থাকলেও খাবার আনতে পারছি না।’

এখানকার বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ভাত খাইনি বাবা। আমরা গরিব মানুষ। কিন্তু জীবনে ভাত না খেয়ে থাকতে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ভাতের অভাবে মারা যাব।’

তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি ওঠার পর প্রথমে এক দিন রান্না খাবার দিয়ে গিয়েছিল একদল লোক। পরে আরেক দল এসে শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। এই নিয়েই ছয়-সাত দিন ধরে চলছে।’

বাহাদুরপুরের পাশের গ্রামই জালিয়ারগাঁও। বুধবার বিকেলে ওই গ্রামের একটি ইঞ্জিন নৌকা ভিড়তেই ঘরবাড়ি থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ঘিরে ধরেন নৌকাটিকে।

গ্রামের বৃদ্ধ শহিদ আহমদ অভিযোগ করে বলেন, ‘সবাই কেবল রাস্তার পাশেই ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। একটু দূরে ও ভেতরে কেউ আসে না। আমরা বেঁচে আছি কি না তা কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।’

এই গ্রামের শাহেদা বেগম বলেন, ‘আমরা কোনা রকম বেঁচে আছি। কিন্তু শিশুদের নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। তারা তো বন্যা বুঝতে চায় না। খাবারের জন্য কান্না করে।’

এলাকাজুড়ে শিশুখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

এলাকায় খাওয়ার পানিরও সংকট রয়েছে জানিয়ে মোশাহিদ আহমদ নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘এলাকায় যে কয়টি নলকূপ ছিল সেগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই বিশুদ্ধ পানিরও সংকট রয়েছে।’

বুধবার কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী রাজীব রাসেল। তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু এ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে যারা পাচ্ছে তারা প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছে। আবার অনেকে একেবারেই পাচ্ছে না, তারা খুব সংকটে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক দুর্গম এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি। আমরা যেসব এলাকায় ত্রাণ দিয়েছি, সেগুলোতে আগে কেউ যায়নি বলে জানিয়েছিল তারা। ত্রাণবাহী নৌকা আমাদের চোখে পড়েনি।’

বন্যার শুরু থেকেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জফির সেতু। তিনি বলেন, ‘উপজেলার অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা পৌঁছায়নি।’

তিনি জানান, উপজেলার সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র দিঘলবাঁকের পার-ফেদারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে প্রায় ৯টি গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ত্রাণ আসেনি।

উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুর রহমান বলেন, ‘সরকারি যে বরাদ্দ পেয়েছি তা বিতরণ করেছি। নিজেদের উদ্যোগেও বিতরণ করছি। তবে যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তাতে ত্রাণ দিয়ে কুলানো যাচ্ছে না।’

অনেক মানুষই এখন পর্যন্ত তেমন সহায়তা পাননি জানিয়ে ফয়জুর রহমান বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, কিন্তু আরও ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন।’

তবে ত্রাণের কোনো সংকট নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘জেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ টন চাল, ১৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ২ কোটি ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দুর্গম এলাকাগুলোতেও ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত