০৪ জুলাই, ২০২২ ২২:০৮
মবশ্বির আলীর ঘরে পানি। ১২ দিন ধরে তাই সড়কেই পেতেছেন সংসার। বাঁশ, পলিথিন আর ত্রিপল দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে তৈরি করেছেন কোনো রকমে মাথা গোজার ঠাঁই।
সেখানেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন এই কৃষক। এই ছাপড়া ঘরে গাদাগাদি করে থাকে মবশ্বিরের দুইটি গরুও।
রোববার সুনামগঞ্জের পাগলবাজার এলাকায় গিয়ে কথা হয় মবশ্বির আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৫ জুন ঘরে পানি ওঠে। ঘর থেকে এখনও পানি নামেনি। পানিতে ঘরের সব মাটির দেয়াল ভেঙে গিয়েছে। তাই সড়কের পাশেই আশ্রয় নিয়েছি।’
মবশ্বির বলেন, ‘এই ছাপরা ঘরেই বউ, বাচ্চা নিয়ে থাকি। দুটি গরুও থাকে এখানে।
‘রাতে গরুর মলমূত্রের গন্ধে ঘুমানো যায় না। তবু আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। গরুগুলোও কোথাও রাখার জায়গা নেই।’
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার। এই আঞ্চলিক মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জ পার হলেই দেখা যায়, সড়কের দুই পাশে অসংখ্য ছাপড়া ঘর। পুরো সড়কই যেন হয়ে উঠেছে আশ্রয় শিবির।
মবশ্বিরের মতো কয়েক শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে সড়কের পাশে। তাদের সবার ঘরেই বন্যার পানি। কারও ঘর ভেঙেও গেছে পানিতে।
সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া অনেকে নিজেদের হাঁস-মুরগি আর গবাদি পশুও নিয়ে উঠেছেন এখানে। এসব ঝুপড়ি ঘরে মানুষ আর পশু করছে যৌথ বাস।
পাগলা ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের কৃষক সোহাগ আহমদও আশ্রয় নিয়েছেন সড়কের পাশে। সড়কই হয়ে উঠেছে তার অস্থায়ী ঘর।
সোহাগ বলেন, ‘১৫ দিনেও ঘর থেকে পানি নামেনি। যাওয়ার মতোও আর কোনো জায়গা নেই। তাই সড়কের পাশেই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছি।
‘রাত হলে গাড়ির শব্দে ঘুমাতে পারি না। আর বৃষ্টি হলে ছাপড়া ঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে। এসব কষ্ট সহ্য করেই এখানে থাকতে হচ্ছে।’
শনিবার এই সড়ক দিয়ে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে দেখা যায়, সড়কের ওপরই পানিতে ভিজে যাওয়া ধান শুকাচ্ছেন অনেকে। ভেজা আসবাবপত্র আর লেপ-তোশকও সড়কের ওপর রোদে শুকাতে দিয়েছেন তারা।
গবাদি পশুরও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন কেউ কেউ। কয়েকজনকে ছাপড়া ঘরের ভেতরে চুলো জ্বালিয়ে রান্নার আয়োজন করতেও দেখা যায়।
ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত নাজমা বেগম বলেন, ‘আগের বন্যায় বেশিরভাগ ফসল ভাসিয়ে নিয়েছিল। সামান্য যেটুকু ঘরে তোলা গিয়েছিল, তাও এই বন্যায় ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।’
সড়কে শুকাতে দেয়া ধান দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এইগুলা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ধান থেকে আর চাল পাওয়া যাবে না; গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। নিজেরা যে কী খেয়ে বাঁচব, তা বুঝতেছি না।’
সুনামগঞ্জের জানিগাঁও ইউনিয়ন এলাকায় সড়কের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন কুতুব উদ্দিন। গরু আর মুরগির সঙ্গে একই ঘরে রাত কাটে তার।
তিনি বলেন, ‘পশুর সঙ্গে আমাদের জীবনের এখন কোনো পার্থক্য নেই। বন্যায় সব এক হয়ে গেছে। লজ্জা ভুলে ঘরের নারীদের নিয়েও রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।’
গত ১৫ জুন থেকে চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো বন্যা দেখা দেয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে। চলমান বন্যাকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বলছেন অনেকে।
এই বন্যায় তলিয়ে যায় সিলেটের ৭০ শতাংশ আর সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জ জেলা।
তিন দিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল এ জেলা। পানি উঠে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কেও। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল সুনামগঞ্জে।
পানি কমতে শুরু করলেও এখনও প্লাবিত দুই জেলার বেশিরভাগ এলাকা। হাওরপ্রধান সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িঘরে এখনও পানি।
সড়ক থেকে পানি নামার পর এই সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের দুই পাশে অস্থায়ী ঘর বাড়িতে আশ্রয় নেয় প্লাবিত এলাকাগুলোর কয়েক শ পরিবার।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া বেশিরভাগ লোকই ত্রাণের আশায় এখানে থাকছেন। বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চলছে সুনামগঞ্জে।
‘ত্রাণ নিয়ে আসা সকলেই সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক দিয়ে সুনামগঞ্জে প্রবেশ করেন। তাই সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া লোকজন বেশি ত্রাণ পাচ্ছেন।’
সড়কে পশুর সঙ্গে বসবাস
তাদের অনেককে চেষ্টা করেও আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া যায়নি বলে দাবি করেন এই জনপ্রতিনিধি।
আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দুর্গম এলাকায় জানিয়ে দিরাই সড়কে আশ্রয় নেয়া বশির উদ্দিন বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রেরও চারপাশে পানি। সেখানে উঠলে জরুরি প্রয়োজনেও বের হওয়া যায় না। এ কারণে সড়কের পাশেই আশ্রয় নিয়েছি।’
যদিও সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়ায় অনেকেই ত্রাণ দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের জানিগাঁও এলাকায় ছাপড়া ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করা সাবিনা বেগম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি হাওরের মাঝখানে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ওদিকে কেউ ত্রাণ নিয়ে যায় না। এদিকে বন্যায় সবকিছু হারিয়ে আমরা নিঃস্ব। কোনো কাজ করারও সুযোগ নেই। মানুষের সহায়তায় চলতে হচ্ছে।’
বন্যায় ঘর হারানো ব্যক্তিদের সরকারের পক্ষ থেকে গৃহনির্মাণ করে দেয়া হবে জানিয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বন্যায় জেলায় ৪৫ হাজার ২৮৮টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি ভেঙেছে, তাদের সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন করা হবে।’
সড়কের পাশে যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সড়কের পাশে বসবাস করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। তাই যাদের ঘরে এখনও পানি আছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া উচিত।’
আপনার মন্তব্য