২০ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ২১:২০
ছবি: সংগৃহীত
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট বানানো হবে। তাই পার্শ্ববর্তী টিলার মাটি কেটে নিজ জমি ভরাটের কাজে ব্যবহার করেন ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেড মালিক আহমদ রাজীব সামদানী। পাশাপাশি অবস্থানগত ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া রিসোর্ট প্রকল্পের নির্মাণকাজ পরিচালনা করেন।
এ অপরাধে ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেড মালিক আহমদ রাজীব সামদানীকে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরজমিনে পরিদর্শন করে প্রকল্প এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি এখানে ৫ (পাঁচ) তারকা মানের কটেজ, রেস্টুরেন্ট, রিসিপশন, মিটিং কক্ষ ইত্যাদি নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে প্রকল্পের কাজ চলছে সে জায়গা নিচু হওয়ায় পার্শ্ববর্তী টিলা থেকে মাটি কেটে এনে এই জায়গা ভরাট করা হচ্ছে।
‘‘তাছাড়া এ ধরণের প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণের বিধান থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করা হয়নি। তাই এই ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেড নামীয় প্রকল্পের কর্তৃপক্ষকে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ টাকা জরিমানা করা হয়।’’
গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন এই আদেশ দেন। এরআগে গোপন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে যান। সেখানে গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেড নামীয় প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পার্শ্ববর্তী টিলার ভূমি থেকে মাটি কাটার সত্যতা পান। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা এবং সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মোহাইমিনুল হক পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বলা হয় সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ৩য় খন্ড মৌজার ১ নং খতিয়ানের ১৯৪ দাগের (বিএস দাগ নং: ১৯৫) দৃশ্যমান টিলা মাটি কর্তন এবং এই টিলার মাটি ফতেহপুর এস্টেট এ জমি ভরাটের কাজে ব্যবহারের সত্যতা পাওয়া যায়। পরিদর্শনকারী টিম উপজেলা ভূমি অফিসের সাথে আলোচনা করে জায়গা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নিশ্চিত হন।
সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত) এর ৭ ধারা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট জেলার নেতৃবৃন্দ অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মামলা করা হয়। বিবাদীকে ১২ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য নোটিশ করা হয়। এনফোর্সমেন্ট মামলা নম্বর- ৩৬/২০২৪। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিবাদীর পক্ষে শুনানিতে হাজির হন ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার খান মো. মবিনুল হক।
শুনানিতে তিনি জানান, মেসার্স ফাহাদ এন্টারপ্রাইজ নামীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তারা মাটি ক্রয় করেন। উক্ত প্রকল্পের অভ্যন্তরে ৬টি কটেজে মোট ১১টি কক্ষ, মিটিং রুম ও অন্যান্য সুবিধা নির্মাণের বিষয়টি উপস্থিত প্রতিনিধি স্বীকার করেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে ঢিলার মাটি দ্বারা ভূমি উন্নয়নের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। ভবিষ্যতে আর ঢিলা কর্তন করবেন না মর্মে জানান।
শুনানিতে প্রমাণ হয়, টিলার মাটি দ্বারা নিচু জমি ভরাট এবং এই স্থানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ না করে কটেজ নির্মাণের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ দায়ী। বিবাদী অবৈধ টিলার মাটি জেনেও মৌখিক আলোচনায় (বিবাদীর বক্তব্য অনুযায়ী) উক্ত মাটি দ্বারা প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের জন্য প্রায় ৯৬ হাজার ২৫০ বর্গফুট টিলার মাটি কর্তন করেছেন। বিবাদী ফাহাদ এন্টারপ্রাইজ নামীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শুনানিতে হাজির করা ব্যক্তি আদৌ প্রতিষ্ঠানের মালিক নয়। তিনি ট্রাক ও ট্রলি দ্বারা মাটি পরিবহন জাতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন বলে স্বীকার করেছেন। তাই বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ধারা-৭ মোতাবেক (১) এ দপ্তরের ছাড়পত্র ব্যতীত প্রকল্পের নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন ও ঢিলার ভূমি কর্তনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের জন্য ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি টিলার পার্শ্ববর্তী অপরাপর স্থানে টিলা কর্তনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট জেলা কার্যালয়ে নিয়মিত মামলা রুজু করা হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ‘‘সিলেটে টিলা কাটা বন্ধের জন্য উচ্চ আদালতের রায় আছে। তারপরও টিলা কাটা বন্ধ হচ্ছে না। তাই ২০২৩ এ আমরা আদালত অবমাননার নোটিশ পাঠিয়েছি সরকারি দপ্তরগুলোতে। জেলা প্রশাসনকে মৌখিকভাবেও সব সময়ই অবহিত করা হচ্ছে। সমন্বয় সভাতে আমরা ছবি ভিডিও সহ দেখিয়েছি।
‘‘টিলা কাটা বন্ধ করতে বেলার মামলার রায় আছে, রায়ের আদেশ সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য আমরা কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে। কারণ একটি সাইনবোর্ড থাকলে টিলা কর্তনকারী সাহস একটু কম দেখাবেন। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি হবে। কিন্তু বিষয়টিকে কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ হিসেবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা দায়িত্ব। তারা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছেন, যা দৃশ্যমান।’’
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘‘টিলার মাটি দ্বারা নিচু জমি ভরাট এবং এই স্থানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ না করে কটেজ নির্মাণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। বিবাদী পক্ষ মেসার্স ফাহাদ এন্টারপ্রাইজ নামীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মাটি ক্রয় সংক্রান্ত কোন দলিল অথবা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তাছাড়া, মাটি সরবরাহকারী হিসেবে উপস্থাপিত ব্যক্তির নিকট থেকে মাটি ক্রয় বাবদ কি পরিমাণ বিল প্রদান করা হয়েছে, সে সংক্রান্ত কোন দালিলিক প্রমাণ (মাটি সরবরাহের চুক্তিপত্র, বিলের কপি, চেক কিংবা আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তথ্যাদি) উপস্থাপন করতে পারেননি।
‘‘তাই প্রতিবেশ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা করা হয়। সাত কার্যদিবসের মধ্যে জরিমানার টাকা পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর জমা প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’’
আপনার মন্তব্য