নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ নভেম্বর, ২০২৫ ২৩:২৫

সিলেটে প্রার্থী নিয়ে বিএনপিতে অসন্তোষ বাড়ছে, একক প্রার্থী নিয়ে মাঠে জামায়াত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সিলেটের ৬ টি আসনের মধ্যে ৪ টিতে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তবে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দলটিপর মধ্যে অসন্তোষ ও বিভক্তি প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণা না হওয়া আসনগুলোতেও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।

এদিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে জামায়াত। সব আমসনেই এক প্রার্থী ঘোষণা করে অনেক আগে থেকেই গণসংযোগ শুরু করেছে দলটি। দলে প্রার্থী নিয়ে প্রকাশ্যে কোন বিরোধও নেই।

অপরদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। দলটি এককভাবে নাকি জোটগতভাবে নির্বাচন করবে এ নিয়েও অনিশ্চয়তয়ে আছেন নেতাকর্মীরা।


সিলেট-১ (সদর ও সিটি করপোরেশন)

স্বাধীনতার পর আসনটিতে আওয়ামী লীগ ছয়বার, বিএনপি চারবার, জাতীয় পার্টি একবার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার জয়ী হন। এবার আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে বিএনপি ও জামায়াত। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তাঁর সঙ্গে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মুক্তাদির মনোনয়ন পাওয়ায় এখনো নিষ্ক্রিয় রয়েছেন আরিফের অনুসারীরা।

খন্দকার আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘অতীতে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপি এখানে ঐক্যবদ্ধ ছিল। এখনো সবাই ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ।’

এই আসনে প্রথমে কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে মনোনয়ন দিয়েছিল জামায়াত। পরে ২০ মে জেলার আমির ও কেন্দ্রীয় মসলিশে শুরা সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমানকে প্রার্থী করা হয়। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে সিলেট-৬ আসনে নির্বাচন করা হাবিবুরকে সবকিছু নতুন করে গোছাতে হচ্ছে।

এখানে এনসিপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক এহতেশাম হক প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহানগরের সভাপতি তাজুল ইসলাম হাসান, ইসলামী ঐক্যজোটের হাফিজ মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা ফখরুল ইসলাম ও বাসদের সিলেটের সদস্যসচিব প্রণব জ্যোতি পাল প্রার্থী হতে পারেন।

সিলেট-২ (বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর)

‘গুম হওয়া’ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর আসন হিসেবে পরিচিত সিলেট-২। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে গাড়িচালকসহ ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হওয়ার পর থেকে তৎপর হন তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর (লুনা)। অল্পদিনেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এবার তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তাঁকে মনোনয়ন দিলেও আদালতে তাঁর প্রার্থিতা আটকে যায়। পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন গণফোরাম নেতা মোকাব্বির খান।

তাহসিনা রুশদীর বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। দল এখানে ঐক্যবদ্ধ, কারও মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এখানে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত।’

এখানে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আমীর উদ্দিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মুফতি লুৎফুর রহমান কাসেমী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের হোসাইন আহমদ ও খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী মাঠে আছেন।

সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ)

যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক এখানে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁর মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে দলে ক্ষোভ আছে। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এম এ সালাম। কাইয়ুম চৌধুরীর অনুসারীরা এ আসনে দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন। আর এমএ সালাম যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আবার মাঠে সক্রিয়

তবে মালিকের অনুসারীরা বলছেন, বিদেশে থেকে এম এ মালিক আওয়ামী লীগবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। পাশাপাশি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রেখেছেন। দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে তিনি ইতিবাচক কাজেরই ফল পেয়েছেন।

এখানে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মাঠে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ। এ ছাড়া আসনটিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য নুরুল হুদা, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা রেদওয়ানুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবদুল কাইয়ুম হাজীপুরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নজরুল ইসলাম, খেলাফত মজলিসের জেলার সাধারণ সম্পাদক দিলওয়ার হোসাইন ও ইসলামী ঐক্যজোটের হাফিজ মাওলানা মইনুল ইসলাম আশরাফী প্রার্থী হিসেবে প্রচার-প্রচারণা করছেন।

সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ)

এই আসনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, সিলেট-১ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। দ্রুতই আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হবে। ইতোমধ্যে প্রচারে নেমেছেন আরিফ। তবে এতে স্থানীয় বিএনপির একাংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আবদুল হাকিম চৌধুরীকে প্রার্থী করার দাবিতে প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন তার অনুসারীরা।

আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশ পেয়েই তিনি সিলেট-৪ আসনে প্রচারণা শুরু করেছেন। যেখানেই যাচ্ছেন, ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। জনসমর্থন নিয়ে এখানে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করবেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য নেতারাও তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন বলে তিনি আশা রাখেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হাকিম ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিন আহমদ, সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিমের স্ত্রী জেবুন্নাহার সেলিম, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক সহস্বেচ্ছাসেবক-বিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামান এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী।

এখানে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কাজ করছেন দলটির জেলার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। জৈন্তাপুর উপজেলার সাবেক এই চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবেও শক্তিশালী। জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষের পাশে আছি, এর প্রতিদান ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে দেবেন বলে বিশ্বাস রাখি।’

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সাঈদ আহমদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মুহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবুল হাসনাত জালালী, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় ওলামাবিষয়ক সম্পাদক আলী হাসান উসামা ও ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা নাজিম উদ্দীন কামরান প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন।


সিলেট-৫ (কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ)

এই আসনেও কাউকে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। স্থানীয়ভাবে প্রচার আছে, বিএনপির সঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জোট হলে দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি উবায়দুল্লাহ ফারুককে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে এমন হলে স্থানীয় বিএনপিতে ‘অসন্তোষ’ বাড়বে বলে দাবি করেছে একটি সূত্র।

মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি মামুনুর রশিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আশিক উদ্দিন চৌধুরী, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহ্বায়ক মো. জাকির হোসাইন, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ফাহিম আলম ইসহাক চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহসভাপতি শরীফ আহমদ লস্কর উল্লেখযোগ্য।

মামুনুর রশিদ বলেন, ‘ভোটের মাঠে অজনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কেবল জোটভুক্ত হয়ে আসন ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আর মানবেন না।’

এখানে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে জেলার নায়েবে আমির আনোয়ার হোসেন খান। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মুফতি রেজাউল করিম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা রেজাউল করিম জালালী, খেলাফত মজলিসের সিলেট জেলার উপদেষ্টা আবুল হাসান ও ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী আলোচনায় আছেন। এ ছাড়া ‘ফুলতলী হুজুরের’ ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন।

সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার)

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরীকে এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ফয়সল আহমদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী, বিএনপি নেত্রী সৈয়দা আদিবা হোসেন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী প্রমুখ।

এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার পর আমি অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দেখা করেছি। সবাই আমাকে কথা দিয়েছেন, ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।’

এখানে জামায়াতের প্রার্থী ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। তিনি অনেক দিন ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে আসছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মুহা. আজমল হোসেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবদুল আজিজ, খেলাফত মজলিসের যুক্তরাজ্য দক্ষিণ শাখার সভাপতি সাদিকুর রহমান ও ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা রফিকুল ইসলামও প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত