দেবকল্যাণ ধর বাপন

০৮ জুলাই, ২০১৬ ০২:১৭

‘টাকা পয়সা চাই না, ছেলের খুনিদের ফাঁসি চাই’

রাজন হত্যার এক বছর

রাজনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? সামিউল আলম রাজন? গত বছর ৮ জুলাই নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো সিলেটের কান্দিগাও ইউনিয়নের বাদআলি গ্রামের রাজনকে। সেই হত্যার ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পরলে সারা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

আলৈাচিত এই হত্যাকান্ডের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনার কারণে হত্যাকান্ডের চারমাসের মধ্যেই রাজন হত্যাকান্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। চারজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত এই রায় কার্যকর হয়নি। রাজন হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে এখনো বিচরাধীন আছে।
 
এ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো রাজনের কথা মনে করে অশ্রু ফেলেন বাবা আজিজুর রহমান আর মা লুবনা আক্তার নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যান।

বৃহস্পতিবার ঈদের দিন  সিলেটের জালালাবাদ থানার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেদেউলি গ্রামে রাজনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার বাবা-মার সাথে।  বাড়িতে গিয়ে রাজনের প্রসঙ্গ তুলতেই কান্না শুরু করেন রাজনের মা।

আজিজুর রহমান ও লুবনা আক্তারের বড় ছেলে সামিউল আলম রাজন।  বাবা, মা, রাজন আর রাজনের পাঁচ বছরের ছোট ভাই সানিউল আলম সাজনকে নিয়ে ছিল তাদের ছোট সংসার। আজিজুর রহমান পেশায় মাইক্রোবাসচালক। পরিবারের অভাবের মধ্যেও স্থানীয় অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছিলেন  রাজনকে। কিন্তু  অস্বচ্ছলতার কারণে আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠেনি রাজনের। তাই পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বাবার হাতে করা বাগানের সবজি বিক্রি করত রাজন।      

কেমন কাটালেন ঈদ?- এমন প্রশ্নে চোখ মুছেন রাজনের বাবা-মা।

রাজনের বাবা আজিজুর রহমান বলেন, প্রতি ঈদে ছেলেটা নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার আবদার করত। দুই ছেলেকে নিজেদের সাধ্যের মধ্যে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতেন তিনি।

পরিবারের শত অভাবের মধ্যেও যার দুরন্তপনায় ঘর উৎসবে ভরে উঠতো সেই রাজন আর কখনো ফিরবে না। ঈদের খুশি ছুঁয়ে যাবে না ছোট্ট সে রাজনকে। নতুন জামা কিনে দেয়ার আবদার করবে না আর কোনো দিন।

রাজনের ছবি বুকে জড়িয়ে তার মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর সাজিয়ে গুজিয়ে পাঠাতেন ঈদগাহে। কিন্তু এখন কি আর আমাদের সেই ঈদ আর ঈদের খুশি আছে? সব কেড়ে নিয়েছে ওই পাষণ্ডরা।

রাজনের ছোট ভাই সানিউল আলম সাজন বলে, ঈদের দিন আমরা দু ভাই একসাথে নামাজে যেতাম। তারপর বাসায় এসে একসাথে সেমাই খেতাম। আজকে ভাইয়া আর নেই।

এলাকায় ঘুরে কথা হয় রাজনের কিছু বন্ধুদের সঙ্গে। আলাপকালে তারা জানায়, রাজন তার বন্ধুদের নিয়ে ঈদের দিন বেশ আনন্দ করতো। সবাই মিলে এখানে-সেখানে ঘুরতে যেত। কমবেশি সালামিও পেতো এলাকার মুরব্বিদের কাছ থেকে। কিন্তু এবার খেলার সঙ্গীকে ছাড়া ঈদ করতে হলো।

রাজন হত্যার দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হলে বাদেআলী গ্রামে যান অথমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি রাজনের মৃত্যুশোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিহত রাজনের পরিবারকে ৫ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তার ঘোষণা করেন। তবে রাজনের বাবার দাবি এখনো পর্যন্ত তিনি সে টাকা হাতে পাননি। তিনি আরও বলেন, লন্ডন প্রবাসী অলিউর রহমান রাজনের পরিবারের সাহাযার্থে প্রায় ৫ লাখ টাকার একটি অনুদান আনেন। এ জন্য প্রবাসী অলিউর রহমান রাজনের মায়ের কাছ থেকে একটি ফাঁকা চেকও নেন। কিন্তু সে টাকাও পাননি বলে দাবী রাজনের বাবার। পরবর্তীতে রাজনের বাবা সে চেকের বিপরীতে একটি মামলা দায়ের করেন।

তবে রাজনের বাবা-মায়ের এখন একটাই কথা তারা জীবিত থাকতে থাকতেই যেন রাজন হত্যা মামলার সু বিচার দেখে যেতে পারেন। রাজনের বাবার কাছে মামলার আপিলের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কাছে এ সম্পর্কে কোন তথ্য নেই।

রাজনের বাবা আজিজুর রহমান বলেন, কোনো আপোস নয়, যারা কোলের সন্তানকে এভাবে কেড়ে নিয়েছে তাদের ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, টাকা পয়সা চাই না। আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তাদের ফাঁসি চাই। খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মনটা শান্তি হবে না।

দূরন্ত ছেলে আজ শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাড়ির পাশের কবরে। তাই নির্বাক বাবা শেখ আজিজুর রহমান নীরবে তাকিয়ে থাকেন ছেলের কবরের দিকে।

উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

একই বছরের ৮ নভেম্বর আলোচিত এই হত্যা মামলার প্রধান আসামী কামরুলসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে মহানগর জজ আদালত। এর রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করে আসামী পক্ষ। উচ্চ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন আছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত