রাজীব রাসেল

১০ জুলাই, ২০১৬ ১৯:০৭

অব্যবস্থাপনায় সিলেটের পর্যটন, ট্যুরিস্ট পুলিশের অপ্রতুলতা

আজ থেকে ৪/৫ বছর আগেও সিলেটে পর্যটকরা আসতেন কেবল চা বাগান, জাফলং আর মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখতে। তবে অবস্থা পাল্টেছে। গত কয়েক বছরে সিলেটে পর্যটকদের ঘুরাঘুরি তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন স্থান। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দুটি পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে রাতারগুল ও বিছনাকান্দি। লম্বা ছুটিতে আর সপ্তাহান্তে সারাদেশ থেকে দলবেঁধে মানুষ ছুটে আসেন এই দুটি স্থানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে।



এই ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের দীর্ঘ ছুটি কাটাতে মানুষ পরিবার-বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলেন সিলেটে। দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা আর বোমাতঙ্ক উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছিলেন রাতারগুল আর বিছনাকান্দির রূপ দর্শনে। পর্যটকদের ভরসা ছিলো- পর্যটন স্থানগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকবে, চেকপোস্ট থাকবে, বাড়তি নিরাপত্তা দেয়া হবে পর্যটকদের। আসলেই কি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো তাঁদের জন্য?



গত ৯ জুলাই (ঈদের পরদিন) দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পর্যটকদের ব্যাপক ভীড়। জলাবনের গভীরে যাবার নৌকা যাত্রা করছে মোটরঘাট আর পাশের অন্য একটি ঘাট থেকে। নৌকা চালকরা ভাড়া চাইছেন যে যার ইচ্ছামতো- কেউ হাজার, কেউ বা দেড় হাজার। অথচ সেখানে নৌকাভাড়া সর্বোচ্চ পাঁচশ' বা ছয়শ' হবার কথা। ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডা শেষে পর্যটকরা অসহায়ভাবে চেপে বসছেন নৌকায়। নিজেদের এই অসহায়ত্ব জানানোর কোনো জায়গা নেই, পুলিশ নেই, অভিযোগ কেন্দ্র নেই বলে জানান তারা।

বনের ভেতর গিয়ে পর্যটকরা পড়ছেন শব্দ যন্ত্রণায়। বনের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ভয়ানক শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, যা রাতারগুলে নিষিদ্ধ করেছিলো বন বিভাগ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন ২২টি অবৈধ ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে রাতারগুল জলাবনে। স্থানীয় অধিবাসী ও সাধারন নৌকার মাঝিরা জানান, মাঝে মাঝে বন বিভাগের দুয়েকজন টহলে গিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলতে বাধা দেন, কিন্তু সেটা মানে না কেউ। জোরালো ব্যবস্থা না নেয়াই এই সমস্যার কারন বলে তাদের মত।

বনের ভেতরেই একটি বড় নৌকায় সাউন্ড বক্স সহযোগে বিকট শব্দে গান বাজাতে দেখা গেলো একদল তরুন পর্যটককে। পশু-পাখির অভয়ারণ্য রক্ষায় বনে শব্দ করায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছেন না কোনো কোনো পর্যটক, আবার নিষেধাজ্ঞা পালন নিশ্চিত করার জন্যেও নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। ফলাফল, বনের নির্জনতা উপভোগের লক্ষ্যে আসা পর্যটকরা পড়ছেন বিপাকে, ফিরে যাচ্ছেন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে।

পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী আশরাফুল কবির বলেন, "রাতারগুল পর্যটন কেন্দ্র না সংরক্ষিত বনাঞ্চল এ নিয়েই স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নেই, তাই চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। এভাবে চলতে থাকলে এই সোয়াম্প ফরেস্ট ধ্বংস হয়ে যাবে"।

এ ব্যাপারে সিলেট ট্যুরিস্ট পুলিশের ইনচার্জ মোহাম্মদ আব্দুর নূর জনবল সংকটের কথা জানান। ট্যুরিস্ট পুলিশের বর্তমান জনবল দিয়ে সিলেটের কেবল মাত্র ৩টি স্পট কাভার করা সম্ভব হয়। রাতারগুলে এখনো্ ট্যুরিস্ট পুলিশের কোন কার্যক্রম নেই বলে জানান তিনি।

মেরিস্টোপসে কর্মরত ডাক্তার মিথিলা রহমান ছোট বোন আর মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন রাতারগুল ঘুরতে। বিরক্তির স্বরে তিনি সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, "ঢাকার যান্ত্রিক নাগরিকতা ছেড়ে রাতারগুলে এসেছিলাম নির্জনতা আর স্বস্তির সন্ধানে। লাভ তো হলো না। এসব অবৈধ শব্দ যন্ত্রণা বন্ধ করা উচিত।"

একইদিনে প্রায় অভিন্ন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিতে গিয়ে। অন্য সময়ের চেয়ে এবার ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন এখানে। কিন্তু নেই গাড়ি পার্কিং এর সুব্যবস্থা। শতাধিক মাইক্রো, কার, সিয়েঞ্জি হাদারপাড় আর পীরগঞ্জ বাজারজুড়ে অগোছালোভাবে রাখা। বাজারের আশেপাশে জায়গা না পেয়ে অনেক গাড়ি পার্ক করা হয়েছে রাস্তার দু'পাশে। ফলে রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে সারাদিনই লেগে ছিলো তীব্র যানজট। গাড়ি থেকে নেমে দীর্ঘপথ হেঁটে পর্যটকরা পৌঁছতে পেরেছেন নৌকা পর্যন্ত।

নৌকা ভাড়া করতে গিয়েও অতিরিক্ত ভাড়া প্রদানের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। অন্যান্য সময় ১ হাজার টাকায় ভাড়া যাওয়া নৌকার চালকরা ঈদের ছুটিতে ভাড়া হাঁকাচ্ছেন ২ হাজার টাকা। নিরুপায় যাত্রীরাও তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো ট্যুরিস্ট পুলিশ। বিছনাকান্দির সীমান্তসংলগ্ন মূল স্পটে দায়িত্ব পালন করছিলেন ৩ জন বিজিবি সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, বিজিবি সদস্যরা কেবল খেয়াল রাখছেন কোনো পর্যটক যেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় অংশে প্রবেশ করতে না পারেন। এছাড়া বাড়তি কোনো দায়িত্ব তাঁদের নেই।

তবে ট্যুরিস্ট পুলিশের ইনচার্জ মোহাম্মদ আব্দুর নূর সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, " জাফলং, বিছনাকান্দি, লালাখাল এই ৩টি স্পটে ৪ জন করেসাবর্ক্ষনিক আমাদের সদস্যরা আছেন।"

তিনি বলেন, পর্যটকরা অভিযোগ করলেই ট্যুরিস্ট পুলিশ তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবস্থা নেবে। নৌকা চালকদের ইচ্ছেমত ভাড়া নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নূর বলেন, "এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে একটি ভাড়ার চার্ট টাঙ্গিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটা হয়ে গেলে আশা করি এ ধরনের সমস্যা থাকবে না"।

সিলেট থেকে বিছনাকান্দি বেড়াতে যাওয়া মৃদুল দাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছে এখানে। অথচ নিরাপত্তা নেই, সিস্টেম নেই, অভিযোগ জানানোর কেউ নেই। এভাবে কোনো ট্যুরিস্ট স্পট বেশিদিন তার আকর্ষন ধরে রাখতে পারবে না।"

বিছনাকান্দির মূল স্পটে যত্রতত্র বসেছে ছোট ছোট দোকান, যেন ফুটপাতের হকার্স মার্কেট! খাবার-পানীয় আর ভারতীয় পণ্য অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে সেসব দোকানে। দোকানীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দোকান বসানোর স্থান নির্ধারন করে দেয়নি কেউ, কেউ বাধাও দেয় না। আর দোকান চালাতে কাউকে কোনো ভাড়াও পরিশোধ করতে হয় না তাদের।

এভাবেই চরম অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা আর হয়রানীর মধ্য দিয়ে ঈদের ছুটিতে রাতারগুল আর বিছনাকান্দি ভ্রমণ করেছেন লক্ষাধিক পর্যটক। তারা যেমন এসব পর্যটনকেন্দ্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি বিরক্ত হয়েছেন এসব অব্যবস্থাপনায়। সিলেটের পর্যটন শিল্প রক্ষায় অনেকেই কামনা করেছেন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি।
 
সিলেটের পর্যটন সেবা প্রদানকারী  প্রতিষ্ঠান ভিজিট সিলেটের কর্নধার হাসান মোরশেদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সীমিত লোকবল ও উপকরন নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ সিলেটে কার্যক্রম শুরু করেছে দু'বছর। এমনিতে তারা যথেষ্ট আন্তরিক কিন্তু লোকবল এর অভাবে সব জায়গায় তাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছেনা।"

তিনি জানান, "আমরা কিছুদিন আগে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি মহোদয়ের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, জাফলং এ তাদের একটা স্থায়ী ফাঁড়ি হতে যাচ্ছে। শুধু জাফলং না- বিছনাকান্দি, রাতারগুল, লালাখালের মতো স্পটে ব্যস্ত সময়গুলোতে তাদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে যাতে  ট্যুরিস্টরা আশ্বস্ত হন। শুধু নিরাপত্তা নয়, পর্যটন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক বিষয়গুলোতেই ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।"


আপনার মন্তব্য

আলোচিত