দেবকল্যাণ ধর বাপন

১০ আগস্ট, ২০১৬ ২৩:৫৮

এন্টিবায়টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে দোকানির পরামর্শে এন্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ার ফলে আশঙ্কাজনক হারে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বেড়ে গেছে।

এক সমীক্ষায় জানা যায় বাংলাদেশে ২০ ধরনের এন্টিবায়োটিক বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত চারশর বেশি নাম দিয়ে বাজারে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ মূল্যের সিপ্রোফ্লোক্সাসিলিন ব্যবহৃত হচ্ছে দেশে। যার ৮০ ভাগই বিক্রি হয় চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই। ফলে এন্টিবায়োটিকের সব ব্র্যান্ড আইটেম মানুষের হাতের নাগালে। আবার কোন কোন চিকিৎসকরাও কারণ ছাড়াই ঔষধ কোম্পানির প্ররোচনায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

শুধু রেজিস্টার চিকিৎসকরাই নন হাতুড়ে ডাক্তার থেকে শুরু করে ওষুধ বিক্রেতা বা ফার্মেসি মালিকরা এন্টিবায়োটিক বিক্রিতে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করেই কোন না কোন ভাবে ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন এই এন্টিবায়োটিক। এতে বিপদ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সাত-আটটি গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিক ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে গেছে, অর্থাৎ এগুলো জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

সারা দেশেই এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন,অপব্যবহারের কারণে এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা থাকছে না এবং সাময়িকভাবে রোগ সেরে গেলেও,রোগীকে পরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হতে পারে। পরে কড়া ওষুধ ব্যবহার করেও রোগ সারানো সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ফার্মেসিতে এন্টিবায়োটিক বিক্রির ব্যাপারে সিলেট সিভিল সার্জন ডাঃ হাবিবুর রহমানকে  প্রশ্ন করা হলে তিনি সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এটা আমি নিজেও খেয়াল করেছি। সিলেটে ফার্মেসিগুলোতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এন্টিবায়োটিক, সিরেটিভসহ অন্যান্য ঔষধ বিক্রি হচ্ছে অহরহ।"

এই অবস্থাকে ভালোভাবে দেখছেন না বলে উল্লেখ করে বলেন, "যদিও এন্টিবায়োটিকের অনেক উপকারিতা আছে কিন্তু সাম্প্রতিককালে এর ব্যবহারে উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বেশী হচ্ছে। এতে করে মানব দেহে এন্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং মানবদেহে এখন অনেক এন্টিবায়োটিকই কাজ করছে না।"


আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশের সাধারণ লোকজন আর ওষুধ বিক্রেতারা এন্টিবায়োটিক ব্যাবহারের বিষয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে।

এন্টিবায়োটিকের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারে ফলে মানবদেহে রোগ-জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। রোগ প্রতিরোধে এখন অনেক এন্টিবায়োটিকই কাজ করছে না। এ কারণে চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে বেশি। সব মিলিয়ে দেশের জনগণ এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিপদের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। যদিও এন্টিবায়োটিক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া এর ব্যবস্থাপত্র অন্য কেউই দিতে পারেন না কিংবা দেয়া উচিত নয়।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এদেশ ছাড়া আর কোন দেশে মুড়ি মুড়কির মত দেদারসে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয় না।

সিলেটের স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি ঔষধের দোকানে এক বিক্রেতা এবং ক্রেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয় সিলেটটুডের প্রতিনিধির সাথে । দোকানটির বিক্রেতা বলছিলেন,সারাদিন তিনি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দিয়ে যত ঔষধ বিক্রি করেন,তার শতকরা ৭০ভাগ প্রেসক্রিপশনেই এন্টিবায়োটিক ঔষধ দেয়া হয়। ঐ দোকান থেকে শিশু সন্তানের জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঔষধ কিনতে আসেন পিন্টু দে নামের এক ক্রেতা।

তিনি বলছিলেন, চিকিৎসক এন্টিবায়োটিক দিয়েছেন এবং তার শিশু জীবন বাঁচানোর চিন্তা থেকে তিনি বাধ্য হয়ে তা কিনছেন। আরও কয়েকজন ক্রেতাও সেখানে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দিয়ে এন্টিবায়োটিক কেনেন।

তবে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন ক্রেতাকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ঔষধ কিনতে দেখা যায়। তাঁর সাথে কথোপকথন কালে সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধিকে তিনি বলেন “আমার জ্বর হয়েছে। সামান্য এই জ্বরের জন্য ডাক্তারের কাছে গেলে, পাঁচশ টাকা ভিজিট দিতে হবে। তারপর ডাক্তার অনেক টেস্ট দেবে এতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো নেমে যাবে। সে কারণে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই এই ডিসপেনসারিতে এসে এন্টিবায়োটিক নিলাম ।”

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের জন্য তৈরি এন্টিবায়োটিকের অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে হাঁস-মুরগি,গরু-ছাগলের উপরেও। এই অ্যান্টিবায়োটিক মাংসের মাধ্যমে আবার ঢুকছে মানুষের শরীরে। সব মিলিয়ে এন্টিবায়োটিকের ভয়ানক বিপদে আছে দেশের মানুষ।

মাছ-মাংস বা অন্যান্য খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করা এন্টিবায়োটিকের বিপজ্জনক প্রভাব পড়ছে কিডনি ও লিভারের ওপর। আবার এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতাও আরেক বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক কথায় মানুষকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যেমন এন্টিবায়োটিকের বিকল্প নেই,তেমনি সেই এন্টিবায়োটিকের অচেতনতামূলক ব্যবহারের ফলে তা এখন ভয়ানক বিপদ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু দেশে যথেচ্ছভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা,তা পর্যবেক্ষণ করারও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের মানুষের পুষ্টির জোগান দিতে মাছ-মুরগি উৎপাদনের কমতি নেই। তবে এসব মাছ-মুরগি রোগমুক্ত রাখতে কিংবা মড়ক ঠেকাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের এন্টিবায়োটিক ওষুধ। বিশেষ করে ইনজেকশনের মাধ্যমে এসব ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যার বেশির ভাগই রান্নার তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে ওই এন্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে ঢুকে বয়ে আনে মারাত্মক ক্ষতি। বিশেষ করে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করার বড় কারণ হিসেবে মাছ-মাংসের অনিয়ন্ত্রিত এন্টিবায়োটিককে দায়ী করা হয়।

এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে গত মার্চ মাসে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) উদ্যোগে।  ওই সমীক্ষার ফলে বলা হয়, ৫৫.৭০ শতাংশ মানুষের দেহে এন্টিবায়োটিক অকার্যকর। এর অর্থ হচ্ছে যেসব রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫.৭০ শতাংশ এন্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না।

বিশ্লেষকরা বলেছেন,এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধ করা এবং মানুষের সচেতনতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বড় ধরণের কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এখনই বিষয়টিতে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়ার তাগিদও দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঔষধ বিক্রির সত্যতা নিশ্চিত করে ঔষধ প্রশাসন সিলেটের ড্রাগ সুপার মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এ ধরণের অভিযোগ অনেকবার এসেছে, তবে ফার্মেসিতে অভিযান পরিচালনাকালে কোন ফার্মেসীতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঔষধ বিক্রি করতে দেখা যায়নি।" যদিও সব জায়গায় সব সময় অভিযান পরিচালনা করার মত লোকবল নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।

তবে তিনি ক্রেতাদের সচেতনতার বিষয়েও জোর দিয়ে বলেন, “শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে হবে না। এ ব্যাপারে ক্রেতারাও সমানভাবে দোষী। ক্রেতারাই ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঔষধ কিনতে যান, কেন তারা এটা করবেন? ”।


তিনি বলেন, “সচেতনতা সৃষ্টিতে ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আমরা বারবার অনুরোধ করি যেন কোন ফার্মেসী ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সিডেটিভ ঔষধ বিক্রি না করেন। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন”।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত