শাকিলা ববি

০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০১

কাঠে ফুল আঁকে, ফুল ফোটায় শিপন

নির্জীব কাঠে একের পর এক  ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছে সে। শুকনো কাঠের গায়ে ফুটা সেই ফুলে নেই কোন গন্ধ। ১০ বছরের শ্যামলা বর্ণের ছিপছিপে শরীর।  বৈদ্যুতিক মেশিন আর বাটাল দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে নিমিষেই গাছ আর  ফুল ফোটালেও চোখে - মুখে নেই ক্লান্তির ছাপ।

হবিগঞ্জ শহরে খোয়াই ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশে  কাঠমিস্ত্রির দোকানে এক শিশু  কাজ করছে দেখে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তার হাতের খেলা। মেশিনকে  ঠেলছে আর  ধীরে ধীরে ভেসে  উঠছে মরা কাঠের উপর নাম না জানা  লতা ও ফুল। নাম জিজ্ঞাসা করতেই মলিন মুখে এক চিলতে হাসি দিয়ে উত্তর- শিপন। ভাদ্রের ভ্যাপসা  গরমে ঘাম ঝরানো  কষ্টের  ফুল ফুটানোই যেন শিশু  শিপনের কাজ।
    
৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় শিপন। বাবা কফিল মিয়া থেকেও যেন নেই!  মা পেয়ারা বেগম কাজ করেন চারকুল মিলে। উমেদনগর মাদ্রাসা রোডের পাশের বস্তিতে মা ভাইদের নিয়ে থাকে শিপন।

বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতেই শিপন বললো,“আব্বায় আমরারে ফালাইয়া গেছুইনগা। এর ল্যাইগ্গা কামো আইছি। আম্মায় কয়লার মেইলো চাকরি কইরা যে ট্যাকা পাইন ই ট্যাকা দিয়া সংসার চলে না।”

মাত্র ১০ বছর বয়সে মায়ের সাথে সংসারের হাল কাঁধে নিয়েছে সে। কামাল মিয়ার কাঠের নকশার দোকানে মাসে ১৫শত টাকা বেতনে পায় সে, অর্থাৎ প্রতিদিনের মজুরী মাত্র ৫০ টাকা। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত  কাজ।

নিষ্পাপ এই শিশুটি শৈশবকে মাটি চাপা দিয়ে পুরাদস্তুর কর্মজীবী হয়ে গেছে। মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করা এই শিশু স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হওয়ার।

যে বয়সে  স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি  সুযোগ পেলেই  খেলাধুলা আর পাখি, ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ানো কথা সেই সময় একজন কর্মজীবীর মাঠে পা রেখেছে শিপন।

ক্রিকেট ব্যাট আর  ফুটবলের বদলে কাঠের মুগুর, বাটাইল, রোজার মেশিনই যেন তার প্রতিদিনের খেলার সামগ্রী।

স্কুলে পড়ার ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে শিপন বলে “আপা ইচ্ছা আছিল পড়া লেখা কইরা আর্মি অফিসার হইমু। সুযোগ পাইলে পড়তাম। মালিক একবার সুযোগ দিছিলো স্কুলে পড়ার কিন্তু এই কাজ কইরা, স্কুলে গিয়া পড়তে শরীরে কুলায় না।”

ক্লান্ত শরীর ক্ষমা করেনা  শিপনকে। তাই ইচ্ছা থাকলেও  পড়াশুনা তো দূরের কথা, মাটির বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়ে সারাদিনের পরিশ্রান্ত এই শিশুটি।

শিপন জানায়, পুরোপুরি নকশার কাজ শিখে ফেলেছে। শুধু ফিনিসিংয়ের কাজটা শেখা বাকী। প্রথমে কাঠের মাঝে কাগজের ফর্মা রেখে পেন্সিল নকশা আঁকে। তারপর সেই নকাশায় কাঠের মুগুর, বাটাইল, রোজার মেশিন দিয়ে কুপানোর কাজ করে। কুপানোর কাজ শেষ হলে মালিক কামাল মিয়া ফিনিসিংয়ের কাজ করেন।

এই কাজ করতে কেমন লাগে জানতে চাইলে, একটু থেমে কষ্টের হাসি দিয়ে উত্তর দিল ‘ভালোই লাগে’। পরক্ষণে ঝটপট বলে উঠে “আমি টাকা গুনতে পারি। নকশার কাজ ভালো কইরা  শিইক্কা  বড় কাঠের নকশার দোকান দিমু।”  

শুক্রবারে ১ ঘণ্টা ছুটি পায় সে। সেই ১ ঘণ্টা কাটে কখনো ঘুমিয়ে কিংবা  পাশের বাসায় টিভি দেখে। সাকিব খান আর মান্না তার প্রিয় নায়ক। শিপন জানায় ১ ঘণ্টার ছুটিতে মাঝে মাঝে ক্রিকেটও খেলে সে। তার প্রিয় খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান।

শিপনের ওস্তাদ কামাল মিয়া জানান, দেড় বছর যাবত সে কাজ শিখছে । আরো ২ বছর কাজ করলে নকশার সব কাজ শিখে যাবে শিপন। পুরোপুরি কাজ শিখে ফেললে যে কোনো দোকানে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতে পারবে বলে জানান তিনি।

কামাল মিয়া বলেন, শিপনের সব দায়িত্ব ওর মা আমারে দিয়েছেন। ছেলেটা ছোট। তাই বেশি ছুটি দেই না। আশেপাশের পোলাপান ভালো না। ড্যান্ডি খায়, চুরি করে। বেশি ছুটি দিলে খারাপ পুলপানের সাথে থ্যাইক্কা খারাপ হইয়া যাইবো।

বাংলাদেশের আইনে  শিশু শ্রম নিষিদ্ধ, এটা জানেন?  প্রশ্নের জবাবে অনেকটা রাগান্বিত হয়ে কামাল মিয়া বলেন, আইন জানি, কিন্তু কাজ না করলে তাদের পরিবার চলবে কিভাবে? সরকার এইসব গরীব শিশুরার লাইগ্যা কিচ্ছু করে না কেরে। সরকার তো সরকারের নিয়মে চলে। খালি কয় শিশুরার কাজ করার নিয়ম নাই। নিয়ম যখন নাই তো এ শিশুরা কিতা করতো। না খাইয়া মইরা যাইতো নি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত