এস আলম সুমন

০৩ অক্টোবর, ২০১৬ ১৪:৪৫

পারাবত ট্রেনের টিটিই ও এটেনডেন্টদের ‘আসন বাণিজ্য’ চরমে

আধুনিকায়ন হলেও সেবার মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ

ঢাকা সিলেট রুটের জনপ্রিয় আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেসে নতুন বগি সংযোজনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হলেও সেবার মান সেই পুরনো মান্ধাতা আমলেই রয়ে গেছে। টিটিই ও এটেনডেন্টরা (পরিচারক) ট্রেনে বিনা টিকেটের যাত্রী তুলে অসদুপায়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হকার ও বিনা টিকেটের যাত্রীদের উপদ্রবে টিকেটধারী যাত্রীদেরকে আগের মতোই বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

যাত্রীদের অভিযোগ অনেক সময় তারা টিকেট করেও ট্রেনের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে দেখেন বিনা টিকেটের যাত্রী তার আসনটি দখল করে আছেন। আসনটি ছেড়ে দেয়ার কথা বললে উল্টো বিনা টিকেটের যাত্রীর কাছে অপদস্থ হতে হচ্ছে তাদের। এমন ঘটনায় ট্রেনে যাত্রী সেবা দেওয়ার জন্য নিয়োজিত এটেনডেন্ট ও টিটিই কাউকে পাওয়া যায় না। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নানা কারণে ট্রেনটির যাত্রা বিলম্বিত হয়।

গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট রুটে নতুন ১৬টি বগি সংযোজনের মাধ্যমে আন্তঃনগর পারাবত  এক্সপ্রেস ট্রেন নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে। ট্রেনের ১৬টি বগিতে প্রথম শ্রেণি, শীতাতপ চেয়ার ও শোভন চেয়ার ৭১৯ টি আসন রয়েছে। প্রতিদিন এই ট্রেনে দুই সহস্রাধিক যাত্রী বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। প্রায় একমাস পেরিয়ে গেলেও নতুন ট্রেনের সেবার মান উন্নতি না হওয়ায় এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে যাত্রী ও সচেতন মহলে।

কুলাউড়া রেল স্টেশন সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন এই স্টেশন দিয়ে পারাবত ট্রেনে বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার প্রায় চার শতাধিক যাত্রী ঢাকা এবং সিলেটে যান। কুলাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত এই ট্রেনে প্রথম শ্রেণি, শীতাতপ চেয়ার ও শোভন চেয়ার মিলিয়ে মোট ৭০টি আসন বরাদ্দ রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন সিলেটগামী যাত্রী প্রায় ৩ শতাধিক। চাহিদার তুলনায় কম থাকায় বরাদ্দকৃত সবক’টি আসনের টিকেট অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়। যাত্রার দিন সিলেটগামী পারাবতের গড়ে দুইশ’ আসনবিহীন টিকেট বিক্রি হয়। গত ২১ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর  পর্যন্ত কুলাউড়া থেকে সিলেটের ১ লাখ ১ হাজার ৪৩৩ টাকার মোট ১,৬৭১টি টিকেট বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৪২০টি আসন ও ১,২৫১টি আসনবিহীন টিকেট। এবং এই ৬ দিনে কুলাউড়া থেকে ঢাকার আসন ও আসনবিহীন টিকেট বিক্রি হয় প্রায় ৪ শতাধিক।  

সম্প্রতি পারাবতে ভ্রমণকালে দেখা যায়, ট্রেনের প্রতিটি বগিতে অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নির্দিষ্ট গন্তব্যের আসন না পেয়ে অনেক যাত্রী স্ট্যান্ডিং টিকেট করে ট্রেনে উঠেছেন। আবার অনেকে টিকেট না করেই ট্রেনে উঠেছেন। এ সময় দেখা যায় ট্রেনে দায়িত্বরত এক এটেনডেন্ট স্ট্যান্ডিং টিকেট ও বিনা টিকেটের কয়েকজন যাত্রীকে সিটে বসিয়ে তাদের কাছ থেকে অসদুপায়ে টাকা রোজগারে ব্যস্ত। ট্রেনে কোন যাত্রী বিনা টিকেটে ভ্রমণ করলে তাকে গন্তব্যস্থলের জন্য নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে দায়িত্বরত টিটিই তাঁর হাতে লেখা টিকেট দিবেন এমন নিয়ম রয়েছে। অন্যথায় জরিমানা করার বিধানও রয়েছে। কিন্তু ট্রেনে দায়িত্বরত টিটিই’দের এরকম কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। ট্রেনে নিরাপত্তা ও সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত রেল পুলিশ ও এটেনডেন্টরাই যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পারাবতে কুলাউড়া থেকে সিলেটগামী যাত্রী সেলুর রহমান তাঁর নির্দিষ্ট আসনে অন্য এক যাত্রী বসে থাকতে দেখেন। তিনি ওই যাত্রীকে এটা তাঁর সিট বলে দাবি করলে উল্টো ওই যাত্রী বলেন ‘আপনার সিট হলে টিকেট দেখান’। ঢাকা কমলাপুর থেকে সিলেটগামী যাত্রী মির্জা খোরশেদ জানান, বিমানবন্দর থেকে আজমপুরগামী বিনা টিকেটের এক যাত্রী ট্রেনের লাগেজ ক্যারিয়ারে তাঁর (খোরশেদ) ব্যাগটির উপর একটি চটের ব্যাগ রেখে দেন। ওই যাত্রীকে তিনি ব্যাগটি সরিয়ে রাখার অনুরোধ করলে সে তাঁর ওপর ক্ষেপে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ও ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে। এ সময় ট্রেনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও এটেনডেন্টকে বললে তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

ট্রেন যাত্রী সাংবাদিক চয়ন জামান, সাইদুল হাসান সিপন ও শাকির আহমদ জানান, ট্রেনে দায়িত্বরত টিসি সঞ্জয় কুমার হাওলাদার এক যাত্রীকে টিকেট দেখাতে বললে ওই যাত্রী তাঁর টিকেট দেখান। পরে ওই যাত্রী টিসিকে কোন বেইজ (নেমপ্লেট) নেই কেন এবং কোচে বসা ও দাঁড়িয়ে থাকা অন্য যাত্রীদের টিকেট কেন চেক করছেন না জানতে চাইলে টিসি সঞ্জয় কুমার কোন সদুত্তর না দিয়ে উল্টো যাত্রীর ওপর ক্ষেপে যান এবং বলেন এটা আমার ইচ্ছে ‘কার টিকেট চেক করবো কার করব না’। এ সময় তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। পরে ট্রেনের অন্য যাত্রীরা তাঁর পরিচয়পত্র ও নেমপ্লেট দেখতে চাইলে টিসি বলেন আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিন্তু কোন বেইজ দেয়া হয়নি; এই কথা বলেই টিসি সেখান থেকে সটকে পড়ে।

দৈনিক প্রথম আলোর জুড়ী প্রতিনিধি কল্যাণ প্রসূন চম্পু জানান, গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর শশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন নিয়ে আজমপুর স্টেশন থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ৩টি আসন ও ৫টি আসনবিহীন টিকেট ক্রয় করেন। ট্রেনে ওঠার পর দায়িত্বরত এটেনডেন্ট এক হাজার টাকার বিনিময়ে তাদেরকে প্রথম শ্রেণির একটি কেবিনে বসার বন্দোবস্ত করে দেয়। ট্রেনে ভ্রমণরত বেশ কয়েকজন যাত্রী জানান, ট্রেনে নির্দিষ্ট আসনের টিকেট করে উঠেও আসনবিহীন ও টিকেটবিহীন যাত্রীদের তোপের মুখে পড়তে হয়। সিট ছেড়ে দেয়ার কথা বললে ওইসব যাত্রীদের অনেকেই বলেন টিটিই ও এটেনডেন্টরা আমাদের এই সিটে বসিয়েছে। এসব কারণে যাত্রী ও স্টাফদের মধ্যে অনেক বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। অনেকসময় মারধরের ঘটনাও ঘটে। এই ট্রেনে ভিক্ষুক ও হকার ওঠা নিষিদ্ধ থাকলেও তারা এক বগি থেকে অন্য বগিতে চষে বেড়াচ্ছে অনায়াসেই। ট্রেনে যাত্রীদের গাদাগাদি তার উপর হকার, টোকাই ও ভিক্ষুকদের উপদ্রবে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। এছাড়াও ট্রেনের বাথরুম ও বেসিনের জন্য তোয়ালে এবং সাবান থাকার কথা থাকলেও এগুলো পাওয়া যায়নি।

কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার হরিপদ সরকার বলেন, আগের থেকে ট্রেন যাত্রীরা অনেকটা সচেতন। চাহিদার চেয়ে কম আসন থাকলেও সব ট্রেনেই অধিকাংশ যাত্রীরা আসনবিহীন টিকেট কিনে ট্রেনে উঠেন। প্রতিদিন আমার এই স্টেশন থেকে সিলেটের জন্য পারাবতের বিভিন্ন শ্রেণির ৭০টি আসন ছাড়াও  ২ শতাধিক আসনবিহীন টিকেট বিক্রি হয়। মাঝে মধ্যে ট্রেনে স্টাফ ও যাত্রীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় তবে যাত্রী কর্তৃক কোন স্টাফ লাঞ্ছিতের অভিযোগ কখনো পাইনি। বিনা টিকেটের যাত্রী প্রতিটি স্টেশন থেকেই ওঠে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

সিলেট আখাউড়া রেল সেকশনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর কমার্শিয়াল (টিআইসি) নুরুল ইসলাম জানান, পারাবত ট্রেনের যাত্রী সেবার মান আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। এ রুটে অধিকাংশ যাত্রীই টিকেট করে ট্রেনে উঠেন। এই ট্রেনে যাত্রী ও কোন স্টাফ লাঞ্ছিতের কোন অভিযোগ পাইনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত