তপন কুমার দাস, বড়লেখা

০৭ এপ্রিল, ২০১৭ ২১:৪৪

বিলুপ্তির পথে বড়লেখার ঐতিহ্য শীতল পাটি

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার ও তালিমপুর ইউনিয়নের শীতল পাটি শিল্পের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। শীতল পাটি নামে দেশ-বিদেশে এর পরিচিতি রয়েছে। বাজারজাতকরণের সমস্যা, মূলধন ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বংশপরম্পরায় এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই চলে গেছেন অন্য পেশায়।

সম্প্রতি উপজেলার দাসের বাজার ইউনিয়নের দক্ষিণ লঘাটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গুটিকয়েক বাড়িতে পাটি বুননের ব্যস্ততা। ঘরের বারান্দায় পাটির সুনিপুণ নির্মাণ চলছে বিরামহীন। নানা আকৃতির পাটি সূক্ষ্ম বুননে পাচ্ছে নান্দনিক শিল্পরূপ। তবে নেই আগের সেই জৌলুস।

দক্ষিণ লঘাটি গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব লাল মোহন দাস বলেন, "আগে পাটি বানাইয়া (পাটি তৈরি করে) সংসার চলত। এখন আর চলে না। জিনিসপত্রের দাম বেশি। আমরা যে কয়জন পাটি বানাই, তারা আর কোন কাম (কাজ) করতাম পারি না এর লাগি কষ্ট করে আছি। ৪-৫ হাত একটা পাটি বানাইতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। রোজ (দৈনিক শ্রম) ও দামের হিসাবে লাভ হয় না। এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সাহায্য পাইছি না। সরকারি সহযোগিতা পাইলে আমরা ভালোভাবে এই পেশারে চালাইয়া নিতাম পারতাম।"

একই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব মিন্টু দাস ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, "অনেকবার আইয়া ছবি উঠাইয়া লইয়া যাইন। সরকারি লোক পরিচয় দেইন। কিন্তু কোন সাহায্য পাই না। ৮০ টেকা (টাকা) দাম (দর) থাকিয়া পাটি বেচি (বিক্রি করি)। আগে পাটির দাম কম ছিল, বিক্রি বেশি হত। তাই চলা যাইত। এখন দাম বেশি হলেও বিক্রি কম। বাপ-দাদার পেশা, তাই ছাড়তেও পারি না। আমরারে দেখার কেউ নাই।"

পাটি শিল্পের সাথে জড়িতরা জানিয়েছেন, উপজেলার দাসেরবাজার ও তালিমপুর ইউনিয়নের পূর্ব ও দক্ষিণ লঘাটি, পানিশাওয়া, গুলুয়া, গোবিন্দপুর, বাগিরপার, টুকা, মহানারী, কান্দিগ্রাম, মালিশ্রী, গগড়া, বড় ময়দান, দ্বিতীয়ারদেহী সহ অধিকাংশ গ্রামের হিন্দু পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। সময়ের বিবর্তনে বর্তমানে বেশিরভাগ পাটি শিল্পীর ব্যবসার প্রতি অনীহা দেখা দিয়েছে। একসময় এই এলাকাগুলোতে তৈরি হতো নানা ধরনের পাটি। তবে নানা সংকট সত্ত্বেও প্রাণের টানে কিছু পাটি শিল্পী বাঁচিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষের এ শিল্প। একসময় এ অঞ্চলের অনেকেরই প্রধান পেশা ছিল পাটি তৈরি করে বিক্রি করা। কিন্তু বাজারজাতকরণে সমস্যা, প্রকৃত মূল্য না পাওয়া এবং মূলধন সংকটের কারণে এ শিল্পের প্রতি মানুষের অনীহা সৃষ্টি করেছে।

যেভাবে তৈরি হয় পাটি: মুর্তা নামক এক প্রকার সরু গাছের ছাল দিয়ে এই পাটি তৈরি করা হয়। গাছ কেটে ধারালো দা বা বটি দিয়ে গাছটিকে লম্বাভাবে ৪/৫ টুকরো করে গাছের ছাল বা বেত বের করা হয়। অতঃপর এক ঘন্টা বেতগুলো টিনের পাত্রে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে সেদ্ধ করার পর তুলে এনে রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানিতে ১০/১৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়। বেতে রং দিয়ে পাটিকে নানা চিত্রে সাজিয়ে আরও আকর্ষণীয় করা হয়।

পাটির ব্যবহার: সাধারণত মুর্তা বেতের তৈরি শীতল পাটি কিংবা অন্যান্য জাতের সকল প্রকার পাটি গরমের দিনে বিছানার উপর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান- যেমন বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধে নতুন পাটির ব্যবহার অপরিহার্য। বিবাহে কন্যাদানের সময় পিতা-মাতা অন্যান্য নানা সামগ্রীর সাথে একখানা শীতলপাটি বা নকশি করা রঙ্গিন পাটি উপহার দিয়ে থাকেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও নামাজ পড়া বা অন্যান্য পারিবারিক কাজে পাটি ব্যবহার করে থাকেন।

জানা যায়, একসময় দাসেরবাজারের তৈরি রূপালী বেতের শীতল পাটি নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। এসব পাটি ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতেন, যা স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব। বর্তমান আধুনিক প্লাস্টিকের তৈরি মাদুর স্বাস্থ্যসম্মত না হলেও পাটির বিকল্প হিসেবে বাজার এটি সয়লাব হয়েছে।

পাটির নাম, তৈরির সময়কাল ও দাম : মুর্তা বেতের পাটি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-শীতল পাটি, রঙ্গিন বেতের পাটি, সরু বেতের পাটি, প্রার্থনা কিংবা উপাসনার জন্য কমল-কোষ পাটি ইত্যাদি। সাড়ে ৩ হাত ও পৌনে ৫ হাত মাপের একটি সাধারণ পাটি তৈরি করতে ৭-৮ দিন সময় লাগে। বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১২ শ' টাকায়। ৪ থেকে ৫ হাত একটি পাটি তৈরি করতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। দাম পাওয়া যায় ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা।

পাটির হাট: বিভিন্ন বাড়ি থেকে তৈরি পাটি পুরুষ সদস্যরা বাজারে বিক্রির জন্য আসেন। বড়লেখা উপজেলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দাসেরবাজারে নানা জাতের পাটির বিশাল হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার। একসময় এ বাজারে সাপ্তাহিক হাটের দুইদিনে পাইকারি ও খুচরা মিলে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পাটি বিক্রি হত। এখন সেই পরিমাণ বিক্রি হয় না। দাসেরবাজার ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ফেরি করে বিচ্ছিন্নভাবে পাটি বিক্রি করেন অনেকে।

এ ব্যাপারে বড়লেখার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন সিলেটটুডেকে বলেন, "সরকার শিল্প বান্ধব। এই শিল্প একটি হস্তশিল্প। এ শিল্পের সাথে জড়িতদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাদের একটি সংগঠনের আওতায় আনারও কাজও চলছে। উপজেলায় বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণের জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। এদের সরকারি ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এনে পাটি শিল্পের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করে আশানুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।"

আপনার মন্তব্য

আলোচিত