নিজস্ব প্রতিবেদক ও তাহিরপুর প্রতিনিধি

১০ এপ্রিল, ২০১৭ ০১:১৭

সুনামগঞ্জে গো খাদ্যের তীব্রসঙ্কট, গবাদি পশু বিক্রির হিড়িক

চারদিকে থৈ থৈ পানি। ডুবে গেছে হাওরের ফসল। বাড়ির ভেতরেও পানি ঢোকার উপক্রম। ফলে গরু-ছাগল চরানোর মাঠ নেই। ঘাস নেই। বাজারগুলোতে নেই খৈল-ভুসিও।

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর এমন তীব্র খাদ্য সঙ্কট। ফলে বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে নিজেদের গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষকরা।

সুনামগঞ্জের সবচেয়ে নিচু উপজেলা ধর্মপাশা। সবার আগে পানিতে ডুবে যায় এই উপজেলা। এবারও এমনটি হয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অকাল বন্যায় ডুবে গেছে হাওরের ফসল, বাড়ির আঙ্গিনাও। এ অবস্থায় নিজেদের গরু-ছাগল রাখার মতোও জায়গা পাচ্ছেন না এই উপজেলার কৃষকরা। পুরো উপজেলায় নেই গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর মতো ঘাস। সব তলিয়ে গেছে পানিতে।

এই উপজেলার মধ্যনগর এলাকার বাসিন্দা হারাধন দেব বলেন, উপজেলার শানবাড়ি বাজারে এখন মানুষ দাঁড়াবার জায়গা নেই। বাজারের পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে গরু-ছাগল। নিজেদের রাখার জায়গা না থাকা ও খাবার সঙ্কটের কারণে এগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে এসেছেন উপজেলার কৃষকরা। প্রায় অর্ধেক দামে বাইরে থেকে আসা ক্রেতারা এগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

পানিতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে মধ্যনগরে নিজের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন সিলেটের সংস্কৃতি কর্মী বিমান তালুকদার। তিনি বলেন, রোববার দুপুরে ঘন্টাখানেক আমি মধ্যনগর বাজারে ছিলাম। এই এক ঘণ্টায় মধ্যনগর বাজার ঘাটে ১৬টি গরুবাহি ট্রলার এসে ভিড়েছে। এগুলোতে করে শতাধিক গরু বিক্রির জন্য আনা হয়েছে।

এই উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের বাসিন্দা তৌফিক মজুমদার বলেন, আমাদের ১৬ টি গরু ছিলো। ১৩ টিই গত কয়েকদিনে প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন তিনটি আছে। খাদ্য সঙ্কট ও জায়গার অভাবে এগুলোও বিক্রি করে দিতে হবে।


তিনি বলেন, অন্যান্য বছর এরকম সময়ে খরা থাকে। কোনো কোনো বছর বৃষ্টি শুরু হলেও সবকিছু তলিয়ে যায় না। কিন্তু এবার চৈত্র মাসেই পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিলো না।

কেবল ধর্মপাশাই নয় এমন চিত্র পাওয়া গেছে জেলার তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দোয়রাবাজার, ছাতক উপজেলায়ও। সর্বত্রই গো খাদ্যের তীব্রসঙ্কট। গরু-ছাগল চড়ানোরও জায়গা নেই। ফলে উপায়ন্তর না দেখে কম দামেই এগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন গৃহস্থরা।

শাল্লা উপজেলার কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বোরোর আবাদ করেছিলাম। বন্যায় সব তলিয়ে নিয়ে গেছে। এখন নিজের খাওয়ারও জোগাড় করতে পারছি না। গরুকে কি খাওয়াবো। তাই বাধ্য হয়ে গবাদিপশু বিক্রি করতে হচ্ছে।

তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর পাড়ের কৃষক বদরুল মিয়া দুইদিন আগে নিজের ৩টি গরু বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, কিছু দিন আগেও যেগুলোর দাম ৮৫ হাজার টাকা ছিল বাধ্য হয়ে সেগুলো ৫৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, ‘ঋণের টাকা শোধ আর পরিবার চালাতে আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন নৌকা বোঝাই করে গৃহস্থরা তাদের গবাদিপশু বিক্রির জন্য বিভিন্ন জেলার পশুরহাটে নিয়ে যাচ্ছেন। ’

তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, হাওর তলিয়ে যাওয়ায় গবাদিপশুর চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। গরু চড়ানোর জায়গাও নেই। তারউপর ফসল এখনো না উঠায় গরুর জন্য খড়ও কৃষকদের সংগ্রহে নেই। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন বলেন, আগামি কয়েক বছর হাওরডুবির ঘটনা না ঘটলেও কৃষকদের এ আর্থিক ক্ষতি পোষাতে আর গোয়ালে গরু ভরতে এক যুগ লেগে যেতে পারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাহেদুল হক বলেন,পুরো জেলায় গো খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গরু রাখার মতোও জায়গা নেই। অনেকে আবার অভাবের তাড়নায় গবাদিপশু বিক্রি করে ফেলছে। পানি না কমলে এই সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়। তবু কৃষকদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় সে ব্যাপারে আমরা চিন্তা করছি।

উল্লেখ্য, এবছর অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের প্রায় দেড় লক্ষ হেক্টর জমির বোরো ধান। ফলে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে বোরো চাষের মৌসুম শুরু হয়। এপ্রিল মাসে ফসল উঠার কথা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত