তপন কুমার দাস, বড়লেখা

১০ এপ্রিল, ২০১৭ ২৩:৪৫

শরীরে বোমার স্প্লিন্টার নিয়ে কাতরাচ্ছেন বড়লেখার বিপ্লব, চেয়েছেন চিকিৎসা সহায়তা

শিববাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ

সিলেটের শিববাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে আহত বিপ্লব পাল

গত ২৫ মার্চ সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানার অদূরে বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন মৌলভীবাজারের বড়লেখার ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিপ্লব পাল (৪০)। শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে এখন কাতরাচ্ছেন বিপ্লব। নেই চিকিৎসা করানোর সামর্থ। তাই সহায়তা চেয়েছেন সরকার ও বিত্তবানদের কাছে।

আহত হওয়ার পর ২৫ মার্চ রাতেই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ভর্তি করা হয় বিপ্লবকে। কিন্তু চিকিৎসা শেষ না হতেই গত ২ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয় তাকে। ডাক্তাররা বলেছেন, ১৩ এপ্রিল চেকআপ করাতে হাসপাতালে যেতে।

ডাক্তারদের ছাড়পত্র পেয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছেন বিপ্লব পাল। কিন্তু শরীরে রয়ে যাওয়া অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে এখন বিছানায় কাতরাচ্ছেন তিনি। বাড়িতে ফিরে আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন বিপ্লব। এলাকার মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় টেনেটুনে চলছে সংসার ও ওষুধ খরচ। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। সুস্থ না হলে সংসার চলবে কি করে- এই ভেবে এখন বিপ্লবের দিশেহারা অবস্থা। তাই চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সহায়তার দাবি জানান বিপ্লব।

বিপ্লব পাল বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের মৃত কিরেন্দ্র পাল ভাদাই'র দ্বিতীয় ছেলে। সোমবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে আহত বিপ্লবের বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। ঘরে প্রবেশ করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন বিপ্লব। বিছানায় শুয়ে আছেন। স্প্লিন্টার বিদ্ধ শরীর নিয়ে উঠতে পারছেন না। নড়াচড়াও করতে পারছেন না।

শরীরের অবস্থা এখন কেমন জিজ্ঞেস করতেই বিপ্লব পাল বলেন, "অবস্থা বেশ ভালা নায় (ভালো না)। শরীরে যন্ত্রণা করে। রাতে ঘুমাইতে পারি না। ওষুধ কেনার টাকা নাই। ঘরে খাবার নাই। এলাকার লোকজনে সাহায্য দিরা (দেন)। কোনোমতে চলে। ফুসফুসের কাছে, মাথা, বুক, হাত, পিঠ, পায়ে অসংখ্য স্প্লিন্টার। অপারেশন করতে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমার আর্থিক অবস্থা ভালা নায়। স্প্লিন্টার নিয়া বেশ কষ্টে আছি। চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সাহায্য কামনা করছি।"

এ কথাগুলো বলার পর আহত বিপ্লব দুঃসহ সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "মনে হচ্ছে যেন যমের হাত থেকে বেঁচে বাড়ি ফিরলাম। কখনও ভাবিনি স্ত্রী-সন্তান আর স্বজনদের মুখ দেখবো। ভেবেছিলাম হয়টো আত্মীয়-স্বজন কেউ আমার মৃত্যুর খবরও জানতে পারবে না।"

দুই ছেলের জনক বিপ্লব পাল ভ্রাম্যমাণভাবে বিভিন্ন মেলা-অনুষ্ঠানে চিড়া-মুড়ি বিক্রি করে কোনমতে সংসার চালাতেন। অসংখ্য স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি জানান, শিববাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে পৈতপাড়া গ্রামে ভাতিজি রিম্পি রানী পালের অসুস্থতার খবর পেয়ে ২৪ মার্চ তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। ভাতিজির বাড়ি থেকে পরদিন (২৫ মার্চ) মালামাল ক্রয় করার জন্য বের হন। অনতিদূরে আতিয়া মহলে জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে রাস্তায় যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছিলো না তখন।

বিপ্লব জানান, তিনি সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শিববাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে হুমায়ুন রশীদ চত্বরের দিকে যাচ্ছিলেন। আনুমানিক ৭টার দিকে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো বিকট শব্দে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো কিছু পদার্থ পা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে এসে পড়লে তিনি অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তার মনে হয়েছিল, এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে যায়! এরপর পুলিশ ভ্যানে ওঠার পর আর কোন কিছুই মনে নেই তার। অনেক রাতে বুঝতে পারেন তিনি হাসপাতালের বেডে আছেন। শুনেছেন সেখানে তার মতো আহত আরও ৫৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।

বিপ্লব পাল আরও জানান, হাসপাতালে তাকে ৮ দিন সিটে রাখা হয়েছে। প্রথম চারদিন সাংবাদিক ও পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তাদের আসা-যাওয়ার কারণে ডাক্তাররা যত্ন সহকারে চিকিৎসা করেন। দুই পায়ে ব্যান্ডেজ করেন। পা ও শরীর থেকে কয়েকটি স্প্লিন্টার বের করেন। পরের চারদিন ডাক্তাররা আর আগের মতো খোঁজ-খবর নেননি।

বিপ্লব হতাশ কণ্ঠে বলেন, তিনি দরিদ্র মানুষ। কিভাবে চিকিৎসা করবেন আর কিভাবেই বা সংসার চালাবেন? একদিকে সমস্ত শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা, অন্যদিকে স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণের চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছেন। সেদিনের ঘটনার কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে তার। দরজা-জানালার শব্দ শুনলেই ভয়ে চমকে ওঠেন।

বিপ্লবের স্ত্রী রীতা রানী পাল বলেন, "দাদা কিলা চলতাম (কিভাবে চলবো) দুইটা বাচ্চা লইয়া (নিয়া)?। অসহায় হয়ে পড়েছি। আজকে ঘরে চাউল (চাল) নাই। কেউ সাহায্য দিলে চুলা জ্বলবে।"

বিপ্লবের প্রতিবেশী সত্তর ঊর্ধ্ব ইব্রাহিম আলী বলেন, "বাবা আমাদের বিপ্লব কি সাহায্য পাইব? বাবারে প্রচুর মানুষ দেখাত (দেখতে) আর (আসছে)। গ্রামের যে যা পারের (পারছে), তা দিয়া সাহায্য করের (করছে)। ছেলেটার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। কিন্তু ছেলেটার অত টাকা-পয়সা নাই। সরকার যদি তারে সাহায্য না করে, তার চিকিৎসা কেমনে চলব? তার রুজিতে (আয়ে) পরিবার চলে।"

উপস্থিত গ্রামের অন্য মানুষদেরও একই কথা। সবার চাওয়া- দরিদ্র বিপ্লব সুস্থ্য হয়ে উঠুক সবার সহযোগীতায়।

বিপ্লবের ব্যাপারে কথা হয় বড়লেখা উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সুন্দরের সঙ্গে। তিনি জঙ্গিদের বোমা হামলায় আহত হতদরিদ্র বিপ্লব পালের সরকারীভাবে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগতভাবে উপজেলা পরিষদ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "আমরা তার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি। উপজেলা পরিষদ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে আবেদন করতে বলেছি। এছাড়া হুইপ মহোদয়ের (জাতীয় সংসদের হুইপ মো. শাহাব উদ্দিন) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করতে বলা হয়েছে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভান্ডার থেকেও সহযোগিতা মেলে। অসহায় বিপ্লব পালের জন্য বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার।"

আপনার মন্তব্য

আলোচিত