শাকিলা ববি

০৫ জুন, ২০১৭ ০৩:৩৮

হবিগঞ্জে শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সুতাং নদী

হবিগঞ্জে শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। জেলার মাধবপুর উপজেলার ছাতিয়াইন, বাগাসুরা, নোয়াপাড়া, সহ কয়েকটি ইউনিয়নে শহরের আধুনিক সুযোগ সুবিধা তেমন না থাকলেও কৃষিজমি, নদী, খাল, হাস মুরগী, গবাদিপশু নিয়ে স্বস্তির জীবনযাপন করতেন এই এলাকার মানুষজন। নির্মল পরিবেশে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া যেত।

দিন পাল্টাচ্ছে, এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ইউনিয়নগুলোর চিত্র খুব ভয়াবহ। বিভিন্ন কারখানার অপরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাসনের কারণে প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন ওইসব গ্রামের প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। শিল্পকারখানার আশপাশের নদী ও খালে  সরাসরি ফেলা হচ্ছে শিল্পবর্জ্য। নদী ও খালের এ  দূষিত পানির কারণে শাহপুর, এক্তিয়ারপুর, ছাতিয়াইন আলীনগর, উত্তর্নপাড়া, সাঘুচাইল, পিয়াইম, আতুকুরা, কালীনগর, শিবজানগরসহ এলাকার প্রায় ৪০ গ্রামের হাঁস-মুরগি, গরুসহ বিভিন্ন গবাদি পশু মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। অসহনীয় দুর্গন্ধের ভেতর দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ । নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এলাকার জনসাধারণের। বাতাসে দুর্গন্ধ এত তীব্র যে, ওইসব এলাকায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

আজ ৫ জুন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। হবিগঞ্জে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা। এই শিল্পকারখানার দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার বায়ু, মাটি, পানি। যার ফলাফলস্বরূপ মানব কল্যাণে সৃষ্ট এসব কলকারখানা মানুষের জীবন যাপনে সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

২০০৩ সালে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে সংস্কার করে বিশ্বরোডে পরিণত করা  হয়। এর পরই শেরপুর থেকে মাধবপুর উপজেলা পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের জমি কেনার  প্রতিযোগিতা শুরু হয় শিল্প উদ্যোক্তাদের। চোখের নিমিষেই হবিগঞ্জ সদর ও মাধবপুর উপজেলা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দু’পাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। মহাসড়ক, রেল সড়কসহ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, সহজলভ্য শ্রমিক, প্রয়োজনাধিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস, কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতায় খুব দ্রুত উৎপাদনে যায় বেশিরভাগ কোম্পানি। শিল্পবান্ধব পরিবেশ হওয়ায় দেশ বিদেশের নামীদামী রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলেন বিশাল বিশাল শিল্পকারখানা। উৎপাদিত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুড, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, সিরামিকসহ  নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস।

স্কয়ার, প্রাণ, স্টার, বাদশা ও বেঙ্গল গ্রুপসহ দেশি-বিদেশি বড় বড় কোম্পানি সেখানে শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় হাজার হাজার বেকার লোকের। উৎপাদনশীল এই শিল্পকারখানাগুলোতে হাজারো লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হলেও অপরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র বিধ্বংসী বিভিন্ন ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ।

জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের তালিকা অনুযায়ী সারা জেলায় বিভিন্ন কোম্পানির ৩৩টি ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ইন্ডাস্ট্রি আছে মাধবপুর উপজেলায়। এসব কোম্পানিগুলো বিভিন্ন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কোনো হস্তক্ষেপ নেই । তাই উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, এ শিল্পবর্জ্য দূষণের কারণে এ যাবত প্রায় শতাধিক গরু-ছাগল ও ৩ সহস্রাধিক হাঁস-মুরগি মারা গেছে। পাকা ধানের জমি নষ্ট হচ্ছে। মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে খাল-বিল। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে।

এক্তিয়ারপুর এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, মার লিমিটেড নামক কোম্পানির বর্জ্যের পানি একটি পাহাড়ি ছড়ায় নিষ্কাশন করলে ঐ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। এতে ছাতিয়াইন ইউনিয়নের এক্তিয়ারপুর গ্রামবাসীর প্রতিবাদের মুখে কোম্পানিটি একটি পুকুর খনন করে বর্জ্য জমাট করে রাখলেও সুযোগ সুবিধা মত কোম্পানির বর্জ্যের পানি বাঁধ কেটে ফসলের জমির ও এক্তিয়ারপুর খালের উপর ছেড়ে দেয়। এতে প্রতিনিয়তই শতাধিক একর পাকা ধানের জমির,  পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাঁস মুরগি গবাদি পশু মারা যাওয়ার পাশাপাশি দুর্গন্ধে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে অসুস্থ এর প্রতিবাদ সভা, লিখিত অভিযোগ, মহাসড়ক অবরোধসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের পরও কারখানাটি পাহাড়ের ছড়ায় দূষিত বর্জ্য অপসারণ অব্যাহত রাখে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

মাধবপুর উপজেলা নোয়াপাড়া ইউনিয়নের শাহপুর এলাকায় কৃষক শফিকুর রহমান বলেন, যখন আমাদের এলাকায় ‘মার লিমিটেড’ এর কারখানা নির্মাণ হয় তখন মনে হয়েছিল গ্রামবাসীর জন্য ভালো হবে। এলাকার বেকার লোকজন চাকরী পাবে। আমাদের আর্থিক উন্নতি হবে। কারখানায় চাকরি ও হয়েছে গ্রামের বেকার যুবকদের। কিন্তু দুর্গন্ধ আর কোম্পানির বর্জ্যে গ্রাম এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি বিশ্ব রোড দিয়ে যাওয়ার সময় এ কোম্পানির পাশে আসলে পরেই যে কেউ এই  বায়ু দূষণে তীব্রতা অনুভব করতে পারেন।

নয়াপাড়া ইউনিয়নের উত্তর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন বলেন, প্রথম মনে হয়েছিল কারখানাগুলো আমাদের জন্য আর্শিবাদস্বরূপ কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এইগুলো আমাদের জন্য অভিশাপে রূপ নিচ্ছে। এসব কারখানার বর্জ্যে এলাকার নদী, জমি, বাতাস দূষিত হচ্ছে। এর প্রতিবাদে কয়েকবার মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধসহ কোম্পানিতে হামলাও করেছে এলাকাবাসী। কিন্তু এরপরও কোন প্রতিকার নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), হবিগঞ্জের  সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি বিগত কয়েক বছর ধরে হবিগঞ্জ সদর ও মাধবপুর উপজেলার বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প কারখানা। তিন ফসলি কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপন দেশের প্রচলিত নীতি ও আইন-বিরুদ্ধ হলেও এই অঞ্চলে তা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। আমরা ইতিপূর্বে এধরনের শিল্প-কারখানার ‘উৎসে বর্জ্য পরিশোধন’ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং সুষ্ঠু শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় ও  সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে আহবান জানিয়েছি। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এই শিল্পায়ন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে আসছে। যত্রতত্র কৃষিজমি, খাল, ছড়া এবং নদীসহ সকল প্রকার জীবন ও জীবিকা শিল্পদূষণের শিকার হয়েছে। কোনভাবেই কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত বর্জ্য পরিশোধন নিশ্চিত না করে কারখানার বাইরের এলাকায় যে কোন উপায়ে এবং কারখানার অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ করতে পারে না, এটি দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি ব্যবস্থার পরিপন্থী। শিল্প কারখানাগুলোর উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি যথাযথ শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে শিল্প কারখানার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণ থেকে বিরত থাকতে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব রয়েছে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির এ শিল্পকারখানাগুলো বেসরকারিভাবে তৈরি হলেও শিল্প, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে কাজ করছে। মূলত পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্র আনার সময় যে শর্ত দেয়া হয় সেগুলো তারা ঐ সময় মানলেও পরবর্তিতে সে নিয়ম মানেন না। নামে মাত্র কয়েকটি শিল্পকারখানার ইটিপি থাকলেও বেশিরভাগ শিল্পকারখানারই বর্জ্য অপসারণ প্রকল্প (ইটিপি) নেই। জেলা পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অফিস নেই তাই এসব অভিযোগের ক্ষেত্র পত্র আদান প্রদান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত