তপন কুমার দাস, বড়লেখা

০৭ জুন, ২০১৭ ২২:৪৪

বড়লেখার জীবন সংগ্রামী পাঁচ জয়িতার গল্প

জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ইচ্ছেশক্তির জোরে সমাজে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন অনেক নারী। পরিবারের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নেও তাঁরা ভূমিকা রেখে চলেছেন। বন্ধুর পথে চললেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন। তাঁরা সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরাই জয়িতা, বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা। তাঁরা সবার অনুপ্রেরণা।

এরকম পাঁচজন জয়িতা মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নানা প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা-সংকটের সঙ্গে লড়াই করে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন করেছেন।

জীবন সংগ্রামে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার জন্য তারা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত 'জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ২০১৬' নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ পাঁচ জয়িতার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এতে মহিলা বিষয়ক অফিসের কর্মকর্তা মোছাঃ হোসনে আরা তালুকদারের সভাপতিত্বে ও অফিস সহকারি মৃগেন কান্তি ভাদুড়ী’র সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন।

কীভাবে জীবন সংগ্রামে জয়ী হলেন এই পাঁচ নারী? সেটা জানতে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো সেই অনুপ্রেরণাময় বাস্তব গল্পগুলো।

সুনারা বেগমঃ উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা অসহায় দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সুনারা বেগমের মাত্র ১২ বছর বয়সে বাল্য বিয়ে হয় এলাকার যুবক ছিদ্দেক আলীর সাথে। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে স্বামীকে ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় সুনারার পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় স্বামী যৌতুকের জন্য প্রায়ই নির্যাতন করত। এরই মধ্যে একে একে জন্ম নেয় তিনটি সন্তান। কিন্তু থেমে থাকেনি স্বামীর নির্যাতন। শারীরিক, মানসিক কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়ে একপর্যায়ে বাবার বাড়ি চলে যান সুনারা। সন্তানদের দিকে তাকিয়ে নিজের মনোবল দৃঢ় রেখে নতুন উদ্যমে জীবনকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন সুনারা বেগম। স্বামী পরিত্যক্তা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল পরিবেশে ৩ সন্তানকে নিয়ে দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে যান এই সংগ্রামী নারী। ৩টি সন্তানকে সাথে নিয়েই তিনি মাথায় সবজি নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি শুরু করেন। এখন বাড়ির সামনে মুদি দোকান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন সংগ্রাম। এ অবস্থায় তিনি মেয়েদের ভরণ-পোষনসহ চালিয়ে যাচ্ছেন ছেলের পড়াশোনা। নিজের চেষ্টায় নিজেকে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছেন সংগ্রামী এই নারী।

শুক্লা রানী দেবঃ তিন সন্তানের জননী শুক্লা রানী দেব। পিতার সংসারে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন। বিয়ে হয় উপজেলার দাসের বাজার ইউনিয়নের চিন্ময় দেবের সাথে। স্বামীর অনটনের সংসারে সহযোগীতা করতে তিনি সেলাই এর কাজ শেখেন। তারপরও মেটেনি সংসারের অভাব। অর্ধাহারে দিন কাটতে থাকে শুক্লার পরিবারের। কিন্তু অনটনের সংসারে সন্তানদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলেন তিনি। সারাদিন দর্জির দোকানে কাজ করে চালিয়েছেন সন্তানদের লেখাপড়া। সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষা প্রদানের জন্য ধার-দেনা করেছেন। বিক্রি করেছেন শেষ সম্বল জমি। তিন সন্তান শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। এর মধ্যে বড় মেয়ে শিক্ষকতা করছেন। দ্বিতীয় মেয়ে ও তৃতীয় ছেলে মেডিকেলে অধ্যয়নরত। বর্তমানে তাঁর উপার্জন দিয়েই দুই সন্তানের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে।

মাকছুদা বেগমঃ সদর ইউনিয়নের অজমীর গ্রামের আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী মাকছুদা বেগম। কানসাই হাকালুকি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা মাকছুদা বেগমের শিক্ষা জীবন সুখকর ছিল না। পারিবারিক-সামাজিক আর বাল্যবিবাহের বাধা অতিক্রম করে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে পাশ করেন বিএবিএড। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি বাল্য বিবাহ ও ইভটিজিং প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন এই শিক্ষিকা।

শাহ ফাহমিদা জান্নাতঃ উপজেলার বর্ণি ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহ ফাহমিদা জান্নাত (মদিনা)। বর্তমানে বিএ অধ্যয়নরত। অভাবের সংসারে বাবা তাঁর মাকে ত্যাগ করেন। তিনি মায়ের সাথে ওঠেন মামা বাড়িতে। বাবা তাঁদের ছেড়ে দিলেও দমে থাকেন নি ফাহমিদা। অদম্য স্পৃহা এবং মনোবল নিয়ে সংসার চালাতে দর্জির প্রশিক্ষণ নেন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে (মহিলা বিষয়ক, প্রাণিসম্পদ, আনসার ভিডিপি)। নিজস্ব চেষ্টায় গড়ে তোলেন একটি দর্জি দোকান। তাঁর এ উদ্যোগ কিছু দিনের মধ্যে সাড়া ফেলে সর্বত্র। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে অসহায় পরিবারের ৬ জন নারী কর্মরত আছেন। মাসে তাঁর আয় ২০ হাজার টাকার উপরে। বর্তমানে তাকে আর অন্যের সহেযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না।

রুজিনা বেগমঃ পরিবার ও সামাজিক বাধার কারণে লেখাপড়া করতে পারেন নি বেশিদূর। কোনমতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। রুজিনা বেগম বর্তমানে বড়লেখা পৌরসভার (সংরক্ষিত নারী) কাউন্সিলর। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষার প্রসারের কথা চিন্তা করতে তিনি 'আশার প্রদীপ' নামক যুব মহিলা সমিতি গড়েন। সমিতির মাধ্যমে তাদের পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলেন রুজিনা বেগম। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদেরকে প্রশিক্ষিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন দপ্তরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। প্রেরণা যোগান মেয়েদের। যার ফলে মেয়েরা প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি স্বাবলম্বি হচ্ছে। এছাড়া মেয়েদের বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, যৌতুক ও তালাক, নারী নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে সফল হয়েছেন। নিজ উদ্যোগে প্রশাসনের সহায়তায় বন্ধ করেছেন অসংখ্য বাল্য বিবাহ। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাঁর এ অবদান অনন্য।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত