গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৬:৩৩

গোয়াইনঘাটে ভাঙছে নদী, কাঁদছে মানুষ

সিলেটের গোয়াইনঘাটে নদী ভাঙ্গন যেন অভিশাপে রূপ নিচ্ছে। প্রমত্তা পিয়াইনের ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ভিটে মাটিসহ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিদিন এলাকা ছাড়া হচ্ছে নদী ভাঙ্গনে বাড়িঘর হারানো মানুষজন। ভাঙছে নদী, কাঁদছে মানুষ। গোয়াইনঘাটে এ চিত্র যেন নিত্যকার, এ প্রতিচ্ছবি যেন প্রতিদিনের।

পিয়াইন, সারি আর চেঙ্গেরখাল নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির ফসলের মাঠসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। ইতিপূর্বে এই নদীগুলোর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ, পান সুপারির বাগান, চা বাগানের বিশাল এলাকা, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বহু স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ সমূহের মেরামত ও সংস্কার না হওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ সমূহেও ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। উপজেলার ১নং রুস্তুমপুর ইউনিয়নের গোরাগ্রাম, কুনকুরি এলাকায় পিয়াইনের ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ইতিপূর্বে নদী ভাঙ্গনে গোরাগ্রাম গ্রামের একটি সড়ক সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া এলাকার মানুষজনের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি শুরু হয়েছে।

বিছনাকান্দি অভিমুখে পর্যটকবাহী ইঞ্জিন নৌকার ঢেউয়ের ফলে হাদারপার হইতে বিছনাকান্দি পর্যন্ত পিয়াইন নদীর ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। ২নং পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের দক্ষিণ প্রতাপপুর ঢালারপারসহ বিভিন্ন স্থানে পিয়াইনের ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিস্তীর্ন এলাকা বিলীন হচ্ছে। উপজেলার নদী ভাঙ্গন চিত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে পূর্ব জাফলং। প্রমত্তা পিয়াইনের ভাঙ্গনে এখানে ইতিপূর্বে বিলীন হয়েছে শত শত বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির ফসলের মাঠ, চা বাগানের বিশাল অংশ। বর্তমানেও এই খরস্রোতা নদীর ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে।

নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বাউরভাগ, নয়াগাঙ্গের পার, বাউরভাগ হাওর রক্ষা বেড়িবাঁধসহ গোটা এলাকা রয়েছে হুমকির মধ্যে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রমত্তা পিয়াইনের ভাঙ্গন থেকে জানমাল রক্ষায় ১৭ সেপ্টেম্বর এখানকার নদী ভাঙ্গনে শিকার বাউরভাগ এলাকাবাসীর উদ্যোগে একটি মানববন্ধনও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

৪নং লেংগুড়া ইউনিয়নে গোয়াইন নদীর ভাঙ্গনে গোয়াইনঘাট ব্রিজ, উপজেলা টিএন্ডটি অফিসসহ গোটা লেংগুড়া গ্রামটিই বিলীনের উপক্রম হয়েছে। ভাঙ্গন রোধে এলাকাবাসীর উদ্যোগে বাশের আড়া দিয়ে গ্রামসহ স্থাপনা রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

৫নং আলীরগাও ইউনিয়নে সারী ও পিয়াইন নদীর ভাঙ্গনে খলা, কাকুনাখাই, পাচসেউতি লাউবিল নাইন্দার হাওর, তিতকুল্লি, বুদিগাও, সীমার বাজার, মুক্ততলা, বুদিগাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে ভয়াবহ ভাঙ্গনের পাশাপাশি উপজেলা সদরের সাথে এসব হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষাকারী আটলিহাই-নাইন্দা সড়কেও ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে হুমকির মুখে রয়েছে পুরো এলাকা।

৭নং নন্দিরগাও ইউনিয়নের পিয়াইন আর চেঙ্গেরখাল নদীর ভাঙ্গনে জুলুরমুখ, শিয়ালা হাওর, চলিতাবাড়ি, চৌধুরীপার, দারিকান্দি, কচুয়ারপার, রানীগঞ্জসহ বিলীন হচ্ছে অগণিত গ্রামসহ বিস্তীর্ণ জনপদ।

পিয়াইন ও চেঙ্গেরখাল নদী থেকে প্রভাবশালী মহলের দ্বারা নদীর তীরবর্তী স্থান হইতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে এই ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েছে বলে সরজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয়রা জানান।

৮নং তোয়াকুল ইউনিয়নের লক্ষিনগর থেকে মেওয়ারকান্দি দীর্ঘ প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রমত্তা পিয়াইনের ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি ফসলের মাঠ। ৯নং ডৌবাড়ি ইউনিয়নে কাপনা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে লংপুর, হাতিরকান্দি, কাঠালকুড়ি কান্দি, মানিকগঞ্জ বাজারসহ আশপাশের ৭-৮টি গ্রাম। হুমকির মুখে রয়েছে মানিকগঞ্জ বাজারসহ আশপাশের বিশাল এলাকা।

পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ঢালার পার গ্রামের হাজি আব্দুস সালাম জানান, পিয়াইনের ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিলীন হতে চলেছে পুরো ঢালার পার গ্রাম। নদী ভাঙ্গনের শিকার অসহায় এই গ্রামবাসীর কল্যানার্থে সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের বাউরভাগ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন। তিনি জানান, পিয়াইনের ভাঙ্গনে আমরা সর্বশান্ত। ভিটে মাটি হারিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে অগণিত পরিবার। বর্তমানেও খরস্রোতা পিয়াইনের ভাঙ্গন অব্যাহত আছে। এতে করে বাড়িঘর, ফসলি জমি, বাউরভাগ হাওরসহ এলাকা রক্ষায় স্থাপিত বেড়িবাঁধও হুমকির মুখে রয়েছে। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়ে এলাকার অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে ইতিপূর্বে আমরা একটি মানববন্ধনও করেছি।

তোয়াকুলের লক্ষিনগরের পিয়াইন তীরের বাসিন্দা জুগেন্দ্র মালাকার। পেশায় মৎস্যজীবী। হতদরিদ্র এই সনাতন জেলে জানান, প্রমত্তা পিয়াইনই আমাদের সব দুঃখের সাথি। প্রতিদিনই ভাঙ্গন আর ভাঙ্গন। বিগত কয়েক দশকে ভিটেমাটি হারিয়েছে কয়েক শত পরিবার। বর্তমানেও এই নদীর সেই রুপ অব্যাহত আছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের ভিটেমাটি রক্ষায় দয়া করে একটু সদয় হোন।

আলীরগাও ইউনিয়নের  ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল হান্নান জানান, সারি আর পিয়াইনের ভাঙ্গনে পুরো আলীরগাও ইউনিয়নই এখন হুমকির মুখে। বুদিগাও, তিতকুল্লি, নাইন্দা হাওর, সীমার বাজার, বুদি সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্মুখে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। উপজেলা সদরের সাথে এসব হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষাকারী আটলিহাই-নাইন্দা সড়কেও ভাঙ্গন চরম আকার ধারণ করায় গোটা এলাকা হুমকির মুখে আছে।

এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিৎ কুমার পাল জানান, উপজেলার নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ ব্যাপারে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী জানান, গোয়াইনঘাটের নদী ভাঙ্গনের সমস্যাটি আমরা পাউবি, স্থানীয় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবহিত করেছি। আশা করা যায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত