শাকিলা ববি

২৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০২

‘আমার বোনের জীবন নষ্ট করে দিল জালিমরা’

সৌদিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার নারীর স্বজনের আহাজারি

"আমার বইনটা কথা কয় না, খায় না। শরীরে অসংখ্য জখমের দাগ। মাথার চুল জট হয়ে গেছে। দেইক্কা মনে হইছে কতদিন হয় মাতাত তেল পানি পরছে না। কত আশা নিয়া আমার বইনটা বিদেশ গেছিল। আমার বইনের জীবনটা নষ্ট কইরা দিছে জালিমরা।"

এক বুক পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে এভাবেই কেঁদে কেঁদে কথা গুলো বলছিলেন সৌদিআরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা সুনামগঞ্জের রুনার (ছদ্মনাম) ভাই সোহেল মিয়া।

রুনা ভাই বলেন, "যে বোনকে বিদেশ পাঠাইছিলাম সে বোনকে ফিরত পাইছি না। কত সুন্দর আছিল আমার বইন। এই জালিমরা এমন নির্যাতন করছে তার চেহেরাও নষ্ট হইয়া গেছে। ২০১৭ সালের তার ছবি আর আজকে আমার যে বইন পাইছি কোন মিল পাই না।"

বুধবার (২৩ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৯ টায় সৌদি এয়ার লাইনস (এস ভি ৮০) বিমান যোগে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে দেশে ফিরেন রুনা। বাকরুদ্ধ অবস্থায় দেশে ফিরেন তিনি। পরে বিমান বন্দর থেকে প্রবাসী কল্যাণ ডেক্স, ব্র্যাক ও এপিবিএন অফিসের সহায়তায় রওশনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সেখানে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম তত্ত্বাবধায়নে হাসপাতালে রুনাকে সার্বিক সহায়তা করা হয়। মানসিক ও শারীরিক অসুস্থ রুনা কথা বলতে পারছিলেন না। তাই তার পাসপোর্ট দেখে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয় বলে জানান ব্র্যাকের তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন।

পারিবারিক সুবিধার জন্য বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে রুনার পরিবার হাসপাতালে আসার পর তাকে সিলেট হাসপাতালে ভর্তির জন্য নিয়ে যান বলে জানান রুনার ভাই সোহেল।

সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানি গাঁও গ্রামের বাসিন্দা রুনা আক্তার (২৭)। প্রায় ৭ বছর আগে তার বিয়ে হয় একই উপজেলার সেবুল মিয়ার সাথে। ভালই চলছিল তার জীবন। এর মধ্যে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এরপরই স্বামী আরেকটি বিয়ে করে ফেলেন। রাগে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে ২ বছরের মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে।

এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন অফিসে একটি মামলা মামলা করেন তিনি। এর মধ্যেই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সৌদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রুনা। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গৃহপরিচারিকার কাজ দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স হিমেল এয়ার সার্ভিস আরএল-৬৭৪ এর মাধ্যমে সৌদি যান তিনি। সৌদি যাওয়ার পর রুনার স্বামী তালাকনামা পাঠান ও মেয়েকে নিয়ে যান। সৌদি ১৫ মাস কাজ করলেও কোন বেতন পাননি তিনি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র দুই বার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পান রুনা।

এ ব্যাপারে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম হেড শরিফুর হাসান বলেন, "সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও অবহেলিত নারীরাই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছেন। আমরা শুধু তাদের যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পারব। তারা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সেটা আমরা বিন্দু মাত্রও উপলব্ধি করতে পারব না। আজ আমার দেশের মানুষ গরিব বলে তাদের ওপর নির্যাতন হলে তা আলোচনায় আসে না। কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায় না।"

তিনি আরো বলেন, "বাংলাদেশি মেয়েদের নির্যাতন করলে শাস্তি পেতে হয় না সেটা বুঝে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষজন। তাই দেদারছে নির্যাতিত হচ্ছেন বাংলাদেশী নারীরা। ওইসব নির্যাতনকারীদের শাস্তির আওতায় আনাতে হবে। এসব নির্যাতন রোধ করতে ও নির্যাতনকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে অবশ্যই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।"

প্রসঙ্গত, ২০ জানুয়ারি (রোববার) রাত ৯ টা ৫০ মিনিটে এয়ার এরাবিয়া (এ৯-৫১৫) বিমান যোগে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে দেশে ফিরেন ৮১ জন নারী। এর মধ্যে ১২জন ছিলেন সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত