তপন কুমার দাস, বড়লেখা

২২ জুন, ২০১৯ ১৮:০৩

বড়লেখায় সালিশে উপস্থিত না হওয়ায় দুই পরিবারকে সমাজচ্যুত!

মৌলভীবাজারের বড়লেখাগ্রাম্য পঞ্চায়েতের ডাকে সালিশে না যাওয়ায় দুই পরিবারকে সমাজচ্যুত (একঘরে) করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৬দিন ধরে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়। রাস্তায় বের হলে গ্রামের কিছু মানুষ এই বিষয় নিয়ে বিদ্রূপ করে, খারাপ কথা বলে। ‘মামলা দিয়ে কি হবে। কিচ্ছু করতে পারবে না। সারাজীবন একঘরে থাকতে হবে।’ এই ধরনের কথাবার্তা বলে তাদেরকে হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ করেন ওই দুই পরিবারের সদস্যর।

গত শনিবার (১৫ জুন) মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার ইউনিয়নের মালিচিরি গ্রামে সালিশ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। এসময় ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বিকাশ চন্দ্র দাসসহ গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মুরব্বিরা উপস্থিত ছিলেন।

সমাজচ্যুত হওয়া দুজন হচ্ছেন মালিচিরি গ্রামের বিকুল চন্দ্র দাস ও বিধুর চন্দ্র দাস। তারা দুজন আপন ভাই। প্রায় দু’মাস আগে পাশের বাড়ির একজনের সাথে ঝগড়া হয় তাদের পরিবারের সদ্যদের। এই ঘটনার জেরে তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন দুই ভাই।  

সমাজচ্যুত (একঘরে ) হওয়া বিকুল চন্দ্র দাস অভিযোগ করে বলেন, গত প্রায় দু’মাস আগে পাশের বাড়ির একজনের সাথে আমার স্ত্রী, ভাই ও ভাতিজির ঝগড়া হয়। এর জের ধরে তারা লোকজন নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে স্ত্রী, ভাই ও ভাতিজিকে মারধর করে বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করে। এতে আমাদের বাড়ির তিনজনের রক্তাক্ত জখম হয়। তারা বড়লেখা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এই ঘটনায় মামলা করতে গেলে মেম্বার ও গ্রামের মুরব্বিরা বাধা দেন। বিচার করে দেবেন বলে তারা আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা আমানত নেন। কিন্তু বিচারের নামে তারা উল্টো আমাদের উপর দোষ চাপানোর প্রস্তুতি নেন।

তিনি বলেন, দু’মাস অতিবাহিত হলেও তারা বিচার করে দেননি। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি। তাঁরা সময় নিয়েছেন। অসহায়ের মত ঘুরেছি। বিচার করে দেবেন বলে মেম্বার লোকজন নিয়ে আমার সাথে পুতুল খেলা খেলেছেন। আমানতও ফেরত দেননি। পরে বাধ্য হয়ে গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বড়লেখা আদালতে মামলা করেছি।

বিকুল চন্দ্র দাস জানান, মামলার খবর পেয়ে শুক্রবার গ্রামের মুরব্বিরা তড়িঘড়ি করে বিচার ডাকেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বিকুল চন্দ্র দাস ও বিধুর চন্দ্র দাসকে অবগত করেননি। মেম্বার এসে তাদেরকে বলেন ওই ঘটনার বিচার হবে সালিশে। তখন বিকুল চন্দ্র মেম্বারকে বলেন, ‘আপনারা বিচার বসাবেন আমাকে আগে জানাননি কেন। আমারও মুরব্বিদের বলার দরকার ছিল। এভাবে আমি বিচারে বসব না।’ এরপর চেয়ারম্যানও আসেন। বিকুল চন্দ্র তাদেরকেও একই কথা বলেন,

বিকুল চন্দ্র দাস বলেন, আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। বিচার পাইনি। বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছি। এখন মামলায় যা হয় হবে। তখন মুরব্বিরা আমাকে একদিন সময় দেন। আমি পরদিনও তাদের একই কথা জানিয়ে দেই। পরদিন শনিবার রাতে গ্রামের দিগেন্দ্র দাসের বাড়িতে সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে বিকাশ মেম্বার, গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মুরব্বি বিজয় ভূষণ দাস, নিরঞ্জন দাস, সুবুধ দাস, অবুধ দাস ও জগদীশ দাসসহ গ্রামের অনেক লোকজন ছিলেন। পরে বিকাশ মেম্বারসহ পঞ্চায়েতের সকল মুরব্বিদের সিদ্ধান্তে আমাদের দুইভাইকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এরপরের দিন গ্রামের একটি বাড়ির পূজায় সবাই নিমন্ত্রণ পেয়েছে। আমরা পাইনি। সামাজিক বৈঠকেও আমাদের আর ডাকা হয়নি। এছাড়া তারা আমাদের খারাপ আখ্যায়িত করে কাগজে গ্রামের মানুষের দস্তখত নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছে। আমরা মেম্বার, চেয়ারম্যান, সমাজ মানি না। এসব লিখেছে কাগজে।

বিকুল ও তাঁর ভাইকে সমাজচ্যুত (একঘরে) করার সত্যতা নিশ্চিত করে গ্রামের মুরব্বি জগদীশ দাস মুঠোফোনে বলেন, ‘পঞ্চায়েত থেকে তাদের আলাদা করা হয়েছে। সে চেয়ারম্যান, মেম্বার, সমাজ কিচ্ছু মানে না। আমি, মেম্বারও গ্রামের মুরব্বিরাও ছিলেন। কেউ পঞ্চায়েত না মানলে তারে কি করা? সে জন্য একঘরে করা হয়েছে। গ্রামের পূজা, বৈঠক, বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ দেওয়া হবে না। তারাও অনুষ্ঠানে আসতে পারবে না।’

সমাজচ্যুত করার সত্যতা নিশ্চিত করে ইউপি সদস্য বিকাশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘বিচারে সে রাজি হয়নি। পরে গ্রামের মুরব্বিসহ সবাই বসেছেন। বসে তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমিও ছিলাম।’ বিচারে কেউ না বসলে তাকে একঘরে করা কি ঠিক হল? তাও একজন জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো সমস্যা না।’

স্থানীয় দাসেরবাজার ইউপি চেয়ারম্যান কমর উদ্দিন বলেন, ‘মারামারির বিষয় ছিল। ২ মাস আগের। আমিও সমাধান করতে চেয়েছিলাম। বাদী বিচারে রাজি হয়নি। একজনের মনমত না হলে সে বিচার না মানতে পারে। কিন্তু তাকে একঘরে করা ঠিক হয়নি। গায়ের জোরে সব চলে না। অন্যায়ভাবে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে সরিয়ে দিলে সে তো খারাপ হয়ে যাবে।’

এই বিষয়ে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন, ‘বিষয়টি কেউ জানায়নি। তারা এটা কোনোভাবে করতে পারেন না। আমি খোঁজ নিচ্ছি। যারা এটা করেছেন অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


আপনার মন্তব্য

আলোচিত