এস আলম সুমন, কুলাউড়া

০৩ আগস্ট, ২০১৯ ১৮:১৮

এক মাস ধরে ঘরছাড়া মাদরাসা ছাত্রীর পরিবার!

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করেছিলো প্রতিবেশি যুবক। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছিলো ওই ছাত্রীর পরিবার। এরপর একের পর এক হুমকি আসতে থাকে। এই মামলায় জেল থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢুকে একদিন ওই ছাত্রীর মাকে মারধর করে বখাটেরা। একের পর এক হামলা ও হুমকিতে ভয় পেয়ে এক মাস ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকটাই আত্মগোপনে রয়েছে ওই ছাত্রীর পুরো পরিবার।

হামলার শিকার হাজেরা বেগম (১৪) স্থানীয় চাউরুলী জামেয়া সুন্নিয়া মাদরাসার ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। হাজেরা কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের সৈয়দুর রহমানের মেয়ে। দ্বিতীয় দফা হামলায় হাজেরার মা ফাতেমা বেগম (৫২) আহত হন। ৩০ জুলাই ওই ছাত্রীর উপর হামলার পর থেকেই বাড়িঘরছাড়া তার পুরো পরিবার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সৈয়দুর রহমানের সাথে পার্শ্ববর্তী বাড়ির মনাফ মিয়ার পরিবারের লোকজনের সাথে বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধের জেোর ধরে গত ৩০ জুন মাদরাসা যাওয়ার পথে হাজেরা বেগমকে পথরোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে মনাফ মিয়ার ছেলে রুহুল আমিন ওরফে রুপুল। এঘটনায় হাজেরার বাবা সৈয়দুর রহমান বাদী হয়ে থানায় মামলা করলে পুলিশ রুহুলকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। গুরুতর আহত হাজেরা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।

এদিকে মামলা করায় রহুলের পরিবার হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সৈয়দুর তাঁর স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। গত ৮ জুলাই জামিনে মুক্ত হয়ে রুহুল। ১৬ জুলাই সকাল ৯টার দিকে হাজেরার মা ফাতেমা বেগম সন্তানদের স্কুলের বই নিতে আসেন বাড়িতে। এসময় তাঁর ৭ বছরের ছোট ছেলে সাথে ছিলো। বাড়ির সামনে আসার পর রুহুল ও তাঁর পিতা মনাফ মিয়াসহ পরিবারের লোকজন একত্রিত হয়ে ফাতেমা বেগমের ওপর হামলা চালান। এসময় রুহুল ও তাঁর পরিবারের লোকজন ঘরের পিছনের দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে ফাতেমাকে মারধর করে। পরে তাদের চিৎকার শোনে স্থানীয়রা পাশের চাউলউরী গ্রামে থাকা তাঁর (ফাতেমা বেগমের) বোন রহিমা বেগমকে বিষয়টি জানান। রহিমা বেগম এসে ফাতেমাকে আহতবস্থায় উদ্ধার করেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদরাসা ছাত্রী হাজেরার ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। মাসখানেক ধরে ঘরবাড়ি ছাড়া তারা। হাজেরার বাবা মা ও ছোট ভাই পার্শ্ববর্তী চাউলউরী গ্রামে তার বড় খালা রহিমা বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং হাজেরার চিকিৎসা শেষে রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নে তাঁর ছোট খালার বাড়িতে রয়েছেন। স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় রহিমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় হাজেরার মা ফাতেমা বেগমের সাথে।

ফাতেমা বেগম বলেন, জুন মাসের ৩০ তারিখ আমার ছোট মেয়ে হাজেরা সকালে মাদরাসা যাচ্ছিলো। এসময় সময় বাড়ির পাশে রাস্তার মধ্যে আগে থেকে উৎপেতে ছিলো রুহুল। আমার মেয়ের রাস্তা আটকিয়ে তাকে উপোর্যুপুরী দা দিয়ে কোপাতে থাকে রুহুল। মেয়ের চিৎকার শুনে আমি ও স্থানীয় লোকজন এগিয়ে যাই। রুহুল আমাদের দেখে পালিয়ে যায়। রক্তাক্তবস্থায় আমার মেয়েকে প্রথমে কুলাউড়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানেও ডাক্তার তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সিলেট ওসমানী মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী রুহুলকে আসামী করে থানায় মামলা দিলে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম এবং বাড়িতে আমার বড় মেয়ে ও ছোট ছেলে থাকতো। মামলা দেওয়ায় রুহুলের বাবা মনাফ মিয়া, চাচা সায়েদ মিয়াসহ সবাই ফোনে আমার স্বামী সন্তানকে রুহুলের ওপর দেওয়া মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন। প্রাণের ভয়ে বাড়িতে থাকা আমার স্বামী সন্তানরা আমার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এদিকে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে আসে রুহুল। ঢাকায় চাকুরিরত আমার বড় ছেলে আজাদকে সে ফোনে হুমকি দিতে থাকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। যদি মামলা তুলে না নেই তাহলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।’

ফাতেমা আরও বলেন, চিকিৎসা শেষে আমার মেয়ে হাজেরাকে তার ছোট খালার বাড়িতে রেখে আসি। আমি ও আমার স্বামী ঘরবাড়ি ছেড়ে বোন রহিমা বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ১৬ তারিখ সকাল ৯টার দিকে সন্তানদের বই আনতে আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে যাই। বাড়ির রাস্তায় ওঠা মাত্র রুহুল ও তার বাবা মনাফ মিয়া, চাচা সায়েদ মিয়াসহ পরিবারের সবাই আমার ওপর হামলা চালায়। আমি আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বাঁচতে দৌঁড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেই। এসময় তারা আমার ঘরে পিছনের দরজা ভেঙে আমাদেরকে লাঠি দিয়ে মারধর করে এবং বলে রুহুলের ওপর যে মামলা করা হয়েছে সেটি তুলে ফেলতে নয়তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ছেলের চিৎকারে পাশের বাড়ির লোকজন আমার বোনকে ফোনে জানায়। বোন এসে আমাকে উদ্ধার করে।

ফাতেমা ও তাঁর বোন রহিমা অভিযোগ করে বলেন, ‘থানায় মামলা করতে যাই আমরা। রুহুলসহ তার পরিবারের বাকি সদস্যদের অভিযুক্ত করে মামলা করতে গেলে এসআই দিদারউল্ল্যা বলেন রুহুলকে আসামী করা যাবে না। কেন করা যাবে না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাদের বলেন রুহুল যে, জামিনে মুক্ত হয়েছে কোর্টের সেই জামিন আদেশ দেখাতে হবে। তাই এই মামলায় তাকে ছাড়া পুলিশ আমাদের অভিযোগ গ্রহণ করে। জেলের বাহিরে থাকায় রুহুল প্রকাশ্যে আমাদের ঘরবাড়িতে ঢুকতে দেয় না ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছে।’

আহত মাদরাসা ছাত্রী হাজেরা জানায়, ‘কিছুদিন পর আমার মাদরাসার পরীক্ষা। আমি পরীক্ষা দিতে পারবো কিনা জানি না। কারণ আমার দুই হাত অনেকটাই অচল। নিজ হাতে ভাত খেতে পারি না। আমার খালা আমাকে খাইয়ে দেন। রুহুল ও তার পরিবারের লোকজন আমাদের বাড়ি দখলের জন্য প্রায় আমার বাবা মাকে হুমকি দিতো। ৩০ জুন বাড়ি থেকে মাদরাসা যাওয়ার পথে হঠাৎ আমার ওপর হামলা চালায় রুহুল। এখন আমরা বাড়িছাড়া ওদের ভয়ে। আমাকে মারার পরও রহুল এবং তার পরিবারের লোকজন আবার আমার মায়ের ওপর হামলা চালায় মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। যেকোন সময় আমাদের ওপর আবারো হামালা চালাতে পারে এ ভয়ে আমি মাদরাসা ও বাড়িতে যেতে পারছি না।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নিজাম উদ্দিন এ ব্যাপারে বলেন, রমযান মাসে সৈয়দুর রহমান ও রুহুল আমিনের পরিবারের সাথে ছাগল বাধা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিলো। বিষয়টি পরবর্তীতে চেয়ারম্যান আব্দুল মালিকসহ আমরা স্থানীয়ভাবে আপোষ নিষ্পত্তি করে দেই। পরে আবার সৈয়দুরের মেয়ের ওপর এবং সর্বশেষ সৈয়দুরের স্ত্রীর ওপর রুহুলের পরিবার হামলা চালিয়েছে শুনেছি। রুহুল জামিনে জেল থেকেও বের হয়ে এসেছে শুনেছি। তিনি আরো বলেন, এই বিরোধের মূলহোতা রুহুলের চাচাতো ভাই আব্দুল আহাদ। সে ওই এলাকার বিভিন্ন উশৃঙ্খল কর্মকান্ডে সাথে জড়িত।

টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক জানান, গত দুই দিন আগে আমি দুই পক্ষকে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে বসেছি। মাদরাসা ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনার বিষয়টি আইনী প্রক্রিয়া। তবে ওই ছাত্রীর মায়ের ওপর হামলা ও তাদের বাড়িঘর ছেড়ে থাকার বিষয়টি অমানবিক। উদ্যোগ নিয়ে তাদেরকে বাড়িতে ফিরে আনার ব্যবস্থা করবো ও বাড়িতে থাকার জন্য সকল নিরাপত্তা দিবো।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই দিদার উল্ল্যা মোবাইলে শনিবার বিকেলে বলেন, মামলার বাদিরা একেকসময় একধরণের বক্তব্য দেন। ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযোগ নিয়েছি। পরে আবার তাঁরা অভিযোগ পরিবর্তন করে। পরবর্তী মামলার অভিযোগ একাধিকবার দিয়েছে। আমরা একাধিক অভিযোগ সংযুক্ত করে নিয়ে মামলা রেকর্ড করেছি। ঘটনার পর আমি তাঁদেরকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসছিলাম কিন্তু তাঁরা মেয়ের চিকিৎসার জন্য বাড়িতে থাকেনি। গতকাল ওই ছাত্রীর খালা রহিমা বেগমের সাথে সন্ধ্যার আগে মোবাইলে কথা হয়েছে। তখন রহিমা বেগম জানান, ছাত্রীর বাবা বাড়ির আঙিনা ঝাড়ু দিচ্ছেন।

রুহুলের জামিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর জামিনের কোন ডকুমেন্ট থানায় আসেনি। ওসি স্যারের নির্দেশে কিছুক্ষণ আগে কোর্ট ফোন দিলে জানতে পারি রুহুল ৮ জুলাই জামিনে মুক্ত হয়েছে। এখন আমরা এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।

কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ ইয়ারদৌস হাসানের সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে থানায় দুটি মামলা হয়েছে। ওই ছাত্রীর পরিবার ঘরবাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে এখন যেহেতু জেনেছি এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। দ্রুত সরেজমিনে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাবো এবং ওই ছাত্রীকে ও তার পরিবারকে বাড়িতে নিরাপদে থাকার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। রুহুলকে মামলায় অন্তর্ভুক্তি না করার বিষয়ে তিনি বলেন, রুহুল জামিনে মুক্ত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দশ দিয়েছি। যদি সে ঘটনার আগে জামিনে বের হয়ে আসে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত