হৃদয় দাশ শুভ, শ্রীমঙ্গল

০৩ আগস্ট, ২০১৯ ২২:২৪

সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যাচ্ছে রামনগর মনিপুরী পাড়ার দৃশ্যপট

বছর দশেক আগেও যে কোন মনিপুরী পাড়ায় বা মনিপুরী অধ্যুষিত এলাকায় গেলেই দেখা যেত মনিপুরী সম্প্রদায়ের বেশীরভাগ মানুষের ঘরে ঘরে কাঠ দিয়ে বানানো হস্ত চালিত তাঁত মেশিন। বাড়ির নারীরা সেই সকল তাঁত মেশিনে কাপড় তৈরি করার জন্য চরকিতে সুতো ঠিক করার কাজ করতো, কেউ কেউ বিভিন্ন রঙ প্রস্তুতের কাজ করতেন। রঙ করা সুতোগুলো বাড়ির উঠোনে রোদে শুকাতে দেওয়া হতো। সেই শুকনো বিভিন্ন রঙ এর সুতো তাঁতে চড়িয়ে আপন হাতে বিভিন্ন নকশা আঁকতেন মনিপুরী নারীরা। তাদের হাতের স্পর্শে তৈরি হতো শাড়ি, গামছা,ওড়না, মাফলার সহ বিভিন্ন বস্ত্র। এই চিত্রগুলো ছিলে মনিপুরী পাড়ার নিত্যদিনের। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট ,এখন মনিপুরী অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করা যায় হাতে গুনো কয়েকটা তাঁতের

সরেজমিনে সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগর মনিপুরী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মাত্র কয়েকটি বাড়িতে তাঁত রয়েছে। বাড়ির নারীরা অন্যান্য কাজের ফাকে ফাকে তাঁতে কাজ করছেন। কাজের গতি খুবই কম।

কথা হয় প্রিয়া দেবী নামে এক মনিপুরী নারীর সাথে। তিনি বলেন, একসময় আমাদের আয়ের একটা বড় অংশ আসতো তাঁত শিল্প থেকে। কিন্তু ইদানীংকালে এই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে মনিপুরী নারীরা। আগে একটা শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগতো ১ সপ্তাহ থেকে দশদিনের মত কিন্তু এখন একমাসেও একটা শাড়ি তৈরি করা সম্ভব হয় না। অন্যান্য কাজের ফাকে ফাকে শুধু ঐতিহ্যবাহী শিল্প টাকে ধরে রাখার জন্য কাজ করছেন তারা।

মনিকা দেবী নামে আরেক নারী বলেন, মনিপুরী তরুণীরা আস্তে আস্তে তাঁতশিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তাঁতশিল্পে ব্যবহৃত সুতার মূল্য বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত লাভ না পাওয়াও তাঁতশিল্পে অনাগ্রহের একটা বড় কারণ। তাছাড়া বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত মনিপুরী নারীদের শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি-বেসরকারি চাকরি অথবা অন্য কোনো পেশাই এখন লক্ষ্য। তারা তাত শিল্পে তেমন আগ্রহী না ৷

ভুবন সিংহ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, মনিপুরী নারীদের তৈরি বাহারি পোশাকের ও অন্যান্য পণ্যের চাহিদা ও আকর্ষণও ব্যাপক। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মের নারীদের তাঁতশিল্পের প্রতি অনীহা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকেই বিপন্ন করে তুলছে। একসময় মনিপুরী নারীদের বাড়িতে বাড়িতে তাঁত ছিল। সারাদিনই তাঁতে কাপড় বুনা হতো। এখন সময়ের সাথে সাথে মনিপুরী নারীরাও অন্যান্য সরকারি বেসরকারি চাকুরী করছে। তাঁত বুনার মতো সময়ও অনেকে পায় না।

সোনাবরণ সিংহ নামে এক মনিপুরী কাপড় ব্যবসায় বলেন, অর্থের অভাবে আশানুরূপ সুতা না পাওয়ায় অনেকেই কাজ করতে চাইছেন না। যেহেতু এই শিল্পের অনেক কদর দেশে ও বিদেশে রয়েছে। মনিপুরী তাঁতের পোশাকের চাহিদাও বেড়েছে কিন্তু শিল্পকে এগিয়ে নিতে নেই যথাযথ উদ্যোগ। প্রয়োজনীয় সুতা না পাওয়া ও দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁতের কাপড় বুননে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। মনিপুরী তাঁতশিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রসার ও তাঁতিদের রক্ষার জন্য সুদের হার কমিয়ে প্রকৃত তাঁতিদের ঋণ সুবিধা দিলে তারা ভালো কাজ করবে।

এদিকে দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছেও এখন মনিপুরী তাঁত শিল্পের কাপড়ের চাহিদা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পর্যটক ব্যবসায়ী এসকে সুমন ৷ তিনি জানান আগে দেশী বিদেশী পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে এলে মনিপুরী কাপড় কিনে নিয়ে যেতেন কিন্তু এখন আর তারা এসব কাপড় কিনতে চান না ৷

স্থানীয় আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠন উদ্দীপ্ত তারুণ্যের মুখপাত্র সানজিতা শারমিন সিলেটটুডে কে বলেন, অনলাইনে একশ্রেণীর মানুষ মনিপুরী কাপড় বলে যা বিক্রয় করছে তা আসলে মনিপুরীদের তৈরি তাঁতের কাপড় না। অনলাইনে এভাবে কাপড় বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় আসল শিল্পটি আজ হুমকির সম্মুখীন ৷ এখানে ক্রেতাদের একটু সচেতন হওয়া দরকার, মনিপুরী তাঁতের কাপড় কিনতে হলে মনিপুরীদের কাছ থেকেই কেনা উচিত ৷

আপনার মন্তব্য

আলোচিত