শাকিলা ববি

১৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:৫৬

পারিবারিক বিরোধের জেরে সিলেটে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহিত

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সোমবার সকালে নিজ বাড়ির পাশের একটি গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় ৫ বছরের শিশু তুহিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় মরদেহের পেটে দুটি ছুরি গাঁথা ছিলো এবং কান ও লিঙ্গ কাটা। লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডে শিশুর বাবা ও চাচা জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। ইতোমধ্যে চাচা ও চাচাতো ভাই এ ব্যাপারে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এরকম পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ সিলেটে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে। বাড়ছে হত্যাকাণ্ডও। এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত সাড়ে তিন বছরে সিলেট বিভাগে মামলা হয়েছে ৭৭৩টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন, অনৈতিক সম্পর্ক, বিবাহ বিচ্ছেদ, আধিপত্য বিস্তার ও গ্রাম্য বিরোধের জেরে ছোটখাটো সমস্যা থেকে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে। গ্রাম্য বিরোধের জেরেই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে দিরাইয়ের শিশু তুহিনকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কেউই পেশাদার অপরাধী নন। তাই এসব অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়া তেমন কোনও ভূমিকা রাখে না। অপেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে শুধু আইন ও বিচারের মাধ্যমে এ অপরাধ প্রবণতা কমানো যাবে না বলে মনে করেন তারা।

সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডই ঘটছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিরোধের জেরে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এসব হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থার গাফিলতিতেও এসব অপরাধ বাড়ছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র বলেন, ‘গত তিন বছরে সিলেট বিভাগে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে তার বেশিরভাগই পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সংঘর্ষে নৃশংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণ হচ্ছে সামগ্রিক অস্থিরতা। আগে সমাজের প্রভাবশালী কম ছিল। দুই একজন যারাই নেতৃত্ব দিতেন অন্যরা মেনে নিতেন। এখন সে নেতৃত্ব কাজ করছে না।’

পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে সিলেট জেলায় হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৫০টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৪৬টির, ২০১৬ সালে খুনের মামলা হয়েছে ৪০টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২৯টির, ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৫২টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৩৫টির এবং ২০১৮ সালের মামলা হয়েছে ৩৫টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২টির।

২০১৫ সালে হবিগঞ্জ জেলায় খুনের মামলা হয়েছে ৮৯টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৭০টির, ২০১৬ সালে মামলা হয়েছে ৭১টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৫৭টির, ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৮৭টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৫৩টির এবং ২০১৮ সালের মামলা হয়েছে ২৫টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ১টির।

২০১৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৮টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৩৮টির, ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ড মামলা হয়েছে ৫৩টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৪৩ টির, ২০১৭ সালে হত্যাকাণ্ড মামলা হয়েছে ৫৬ টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৩২ টির এবং ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১১ টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২টির।

২০১৫ সালে মৌলভীবাজার জেলায় খুনের মামলা হয়েছে ৫০টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৩৭ টির, ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ড মামলা হয়েছে ৪২ টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২৮ টির, ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৪৯ টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২ টির এবং ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১৫ টি, এর মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ১টির।

তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা প্রসঙ্গে সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র বলেন, ‘মামলার চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিদিষ্ট কোনও সময়ের বিধান নেই। তবে যা দিয়ে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চলে সেটি ১২০ দিনের মধ্যে দিতে হয়। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট না গেলে কোর্ট আসামিকে জামিন দিয়ে দিতে পারে।’

তবে হত্যা মামলার ক্ষেত্রে ১২০ দিনের মধ্যেই তদন্ত কাজ শেষ হয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চার্জশিটের ক্ষেত্রে পুলিশের সমস্যা হয় ময়না তদন্ত ও মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে। এসব ঘটনায় মামলায় নিহতদের পাশাপাশি আহতরা যেসব জায়গা থেকে চিকিৎসা নেন ওই সব জায়গা থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেটগুলো নিতে সময় লেগে যায়। এছাড়া ক্লু-লেস মামলাগুলোর ক্ষেত্রে চার্জশিটের জন্য কোনও টাইমফ্রেইম দেয়া যায় না।’

চার্জশিটে বিলম্ব হওয়ার আরেকটি কারণ আদালতে চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দেওয়া উল্লেখ করে অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র বলেন, ‘বাদী চার্জশিটে সন্তুষ্ট না হলে সে চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেয়। নারাজি দিলে কোর্ট এটা গ্রহণ করতে পারে আবার না ও করতে পারে। নারাজি আবেদন নিয়ে চার্জশিট পর্যালোচনা করে যদি আদালত সন্তুষ্ট হয় তাহলে কোর্ট নারাজি খারিজ করে দিতে পারে। যদি আদালত মনে করে এখানে আরও তদন্তের বিষয় আছে তখন নির্দিষ্ট পয়েন্ট উল্লেখ করে পাঠানোর নিয়ম আছে। তবে এখন এ নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। পয়েন্ট উল্লেখ না করে পূর্ণ তদন্তের জন্য দিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আবার নতুন করে চার্জশিট দিতে হয়। এ জন্যই চার্জশিট প্রক্রিয়ায় আরও দীর্ঘ হয়ে যায়।’

পুলিশ চার্জশিট দিলেই বিচারক মামলা শেষ করতে পারছেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মূলত চার্জশিট প্রক্রিয়াটি দেরি হয় কোর্টে যাওয়ার পর। আমাদের তদন্ত শেষ হয় তিন মাসে না হয় ৬ মাসে, কিন্তু কোর্টের বিচারকার্যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া লাগে। একটি মামলার রায় আসতে ৮ থেকে ১০ বছর লেগে যায়।’

এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়ও কারণ দেখানো হয় পুলিশ সাক্ষী হাজির করে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সাক্ষী ঠিকই হাজির করে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বাদী বিবাদী ও কোর্টের জটিলতায় সাক্ষী ফেরত যায়। যে সাক্ষী একবার ফেরত যায় ওই সাক্ষীকে আবার কোর্টে আনা খুব মুশকিল। এসব বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ দিন লাগার কারণে, ঘটনার পর পর মানুষের মনে যে প্রতিশোধ বা প্রতিবিধান নেওয়ার ইচ্ছা থাকে সেটা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তাছাড়া এসব সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ যেহেতু পরিবারে আরেক সদস্য ঘটায় তাই তারা কিছুদিন পর মিলে যায়।

তিনি বলেন, ঘটনা ঘটার পর মামলা করলেও কিছুদিন পর বাদী-বিবাদী মিলে গেলে কেউ কোর্টে যেতে চায় না। এর মধ্যে যারা বিচারপ্রার্থী আছেন তাদের বিচার পাওয়ার মানসিকতা হারিয়ে যায় বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে। এরপর তারা নিজেদের মধ্যে সালিশে সমঝোতা করে ফেলেন। বিচার দ্রুত হলে এসব ঘটনা সালিশে শেষ করার প্রয়োজন হতো না।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত