২৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:২৯
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে বালাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে ওঠেছে তিনটি পাথর ভাঙার কল (স্টোন ক্রাশার মেশিন)। দিনভর উচ্চ শব্দে পাথর ভাঙা হয় এসব কলে। পাথর ভাঙার ফলে সৃষ্ট ধুলোয় অন্ধকার হয়ে থাকে পুরো এলাকা। ধুলো ও শব্দের কারণে এই বিদ্যালয়ে ব্যাহত হয় পাঠদান। শিক্ষার্থীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে ঘনঘন।
এই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দিনের বেলাও স্কুলের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। তবু ধুলো আর শব্দ ঠেকানো যায় না। আর এখানকার শিক্ষার্থীদের কাশি-সর্দি লেগেই থাকে।
সিলেটের সদর উপজেলার ধোপাগুল। এখানে সড়কের গা ঘেঁষেই ঘড়ে ওঠেছে অসংখ্য পাথর ভাঙার কল। পাশেই সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে। কল থেকে পাথরগুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকায়ও। এই সড়ক দিয়ে যাওয়া বিমানযাত্রীদেরও পড়তে হয় দুর্ভোগ।
কেবল এই একটি-দুটি এলাকা নয়, সিলেটের সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট এ পাঁচ উপজেলার যত্রতত্র গড়ে ওঠেছে দেড় হাজার পাথর ভাঙার কল। অনেকক্ষেত্রে আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমি ধ্বংস করে গড়ে ওঠছে এসব কল। এদের একটিরও নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র। অবৈধ এসব কল শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের হুমকি হয়ে ওঠেছে।
পাথর ভাঙার কলের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে এক রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ আলাদা একটি ‘জোন’ করে সিলেটের সব পাথর ভাঙার কলকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। তিন মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন আদালত। এছাড়া যত্রতত্রভাবে গড়ে ওঠা সব অবৈধ কল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেন আদালত। তবে প্রায় ৩৩ মাস পেরোতে চললেও বাস্তবায়িত হয়নি আদালতের নির্দেশনা। ফলে যত্রতত্রই রয়ে গেছে পাথর ভাঙার কলগুলো।
এছাড়া ‘স্টোন ক্রাশিং ক্রাশার মেশিন স্থাপন নীতিমালা ২০০৬’ অনুসারে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫০০ মিটার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ১০০ মিটার এবং প্রধান সড়ক-মহাসড়কের ৫০ মিটারের মধ্যে কোনো পাথর ভাঙার কল স্থাপন করা যাবে না।
এসব বিষয়ে আলাপ করতে সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন, আদালতের নির্দেশনার স্টোন ক্রাশার জোন স্থাপনের জন্য গোয়াইনঘাটের তামাবিলের পাশে জায়গা নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। এটি এখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য পাথর গুঁড়ো করা অপরিহার্য। এ অবস্থায় পাথর ভাঙার কলগুলোকে বৈধতা দিতে ২০০৬ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। খোলা জায়গায় যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব কল পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করায় ২০১৩ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আলাদা আরেকটি নীতিমালা করে। স্টোন ক্রাশিং মেশিন স্থাপন নীতিমালা (সংশোধিত ২০১৩)’ নীতিমালায় সিলেটে পাথর ভাঙার কল স্থাপনের প্রথম শর্ত ছিল ‘স্টোন ক্রাশার জোন’ করতে হবে।
এই নীতিমালা উপেক্ষা করে যত্রতত্র পাথর ভাঙার কল স্থাপন করে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোয় ২০১৫ সালে উচ্চ আদালতে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এই রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনমাসের মধ্যে পাথর ভাঙার কলগুলোর আলাদা জোন করার নির্দেশ দেন আদালত।
এ ব্যাপারে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, আদালতের নির্দেশনার পর প্রথমে জৈন্তাপুরে ও পরে গোয়াইনঘাটে একটি জোন করার উদ্যোগ নিয়েছিলো জেলা প্রশাসন। এরপর এ উদ্যোগ আর এগোয়নি। এখন কোন অবস্থায় আছে তাও জানি না।
২০১৫ সালে বেলা’র করা রিটে সিলেটের পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৬০৬টি পাথর ভাঙার কল অনুমোদনহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। গত চার বছরে এই সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বেলা’র সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে নতুন করে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় গড়ে ওঠেছে কয়েকটি কল।
জেলা প্রশাসন জানায়, নীতিমালার আলোকে কোনো পাথর ভাঙার কল পরিচালিত না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে সবই অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের দিকে জেলা প্রশাসনের একটি দল কলগুলোকে অঞ্চলভুক্ত করার জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় জৈন্তাপুর উপজেলার ডিবির হাওর এলাকায় স্টোন ক্রাশার জোন স্থাপনে প্রাথমিক জরিপ চালানো হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ডিবির হাওরের ওই এলাকা লাল শাপলা ফুল ফোটার জন্য পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছিল। তাই এই হাওরে ‘স্টোন ক্রাশার জোন’ স্থাপনের বিরোধিতা করেন পরিবেশবাদীরা। একইসঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ওই জায়গায় জোন স্থাপনে ব্যবসায়ীরাও আপত্তি জানান। এরপর ২০১৮ সালে গোয়াইনঘাটের তামাবিল স্থলবন্দরের পাশে একটি জায়গা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণ করে জেলা প্রশাসন।
সিলেট স্টোন ক্রাশার মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মাসুদ আহমদ চৌধুরী বলেন, পরিবেশের যে নীতিমালা রয়েছে তা মেনে স্টোন ক্রাশার মেশিন স্থাপন করা সম্ভব নয়। পরিবেশের নতিমালায় বলা হয়েছে আশপাশের ৫০০ একরের মধ্যে কোনো বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল থাকতে পারবে না। এমন জায়গা দেশে কোথায় পাওয়া যাবে। এটি মানতে হলে ৫ শতাংশ কলও টিকবে না।
তিনি বলেন, সব কল বন্ধ করে দিলে তো দেশে পাথরের বিরাট সঙ্কট দেখা দিবে। এই সেক্টরে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ক্রাশিং জোন নির্মাণের জায়গা নিয়ে মাসুদ আহমদ বলেন, ক্রাশিং জোন নির্মাণে আমাদের আপত্তি নেই। তবে তা ব্যবসায়ীদের সুবিধাজনক স্থানে হতে হবে। যেখানে গেলে ব্যবসা হবে না সেখানে ব্যবসায়ীরা যাবে কেনো?
আপনার মন্তব্য